সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
রোহিঙ্গা সমস্যার আঙ্গিকগুলো
রোহিঙ্গা সমস্যার যে আঙ্গিকগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলো হলোÑ এক. রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আশ্রয় দেয়া; দুই. আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণতৎপরতায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা; তিন. মিয়ানমারের অমানবিক হিংস্র কর্মকাণ্ড তথা মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর প্রতিবাদ করা; চার. নিজস্ব তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে সসম্মানে ফেরত পাঠানো, পাঁচ. বাংলাদেশের কূটনীতির অনানুষ্ঠানিক সমীক্ষা তথা ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করা, ছয়. ভারত নামের বহুলঘোষিত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত অবন্ধুপ্রতিম কূটনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা, সাত. মিয়ানমার কর্তৃক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে সীমালঙ্ঘনের সমালোচনা করা ইত্যাদি। যে আঙ্গিকগুলোর আলোচনা এখনো গতি পায়নি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই সমস্যার কী প্রভাব পড়তে পারে? অন্য কথায় বলতে গেলে, রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক দিক বাদ দিয়ে, সমস্যা থেকে উদ্ভূত নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে আলোচনা।
জাতীয় নিরাপত্তার কয়েকটি আঙ্গিকের উদাহরণ
‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বলতে অনেক কিছুই বোঝায়। জাতীয় নিরাপত্তা মানে কোনো মতেই যুদ্ধ করা বা না করা নয়। কয়েকটি উদাহরণ দিই।
এক. সুন্দরবন থেকে ১০ বা ২০ কিলোমিটার উত্তরে রামপাল নামক স্থানে, ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে, বাংলাদেশের খরচে, কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে, সুন্দরবনের কী ক্ষতি হতে পারে এবং সুন্দরবনের ক্ষতি হলে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হতে পারে, এটা জাতীয় নিরাপত্তার একটি আঙ্গিক।
দুই. পৃথিবীব্যাপী আলাপ-আলোচনা চলছে জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে বেশ কিছু ভূখণ্ড ডুবে যাবে, ডুবে গেলে অনেক জনপদ ও বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এটাও জাতীয় নিরাপত্তার একটি আঙ্গিক।
তিন. বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে কক্সবাজার জেলার সমুদ্রসীমা থেকে পশ্চিম দিকে অল্প দূরত্বে ছোট্ট একটি দ্বীপ আছে, নাম সোনাদিয়া। সোনাদিয়া দ্বীপকে কেন্দ্র করে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করার আলোচনা অনেক দিন ধরে চলেছে। বৃহৎ একটি অর্থনৈতিক শক্তিসম্পন্ন দেশ বা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের অন্যতম একটি দেশ যার নাম চীন, এই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর কাজে বাংলাদেশকে ব্যাপক সাহায্য করতে প্রস্তাব দিলো। চীনের এই প্রস্তাব গ্রহণ করা বা না করা বাংলাদেশের এখতিয়ার। বাংলাদেশে সরকার নিজের বুদ্ধিতে অথবা বন্ধুদের বুদ্ধিতে, চীনের প্রস্তাব গ্রহণ করল না। এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করা বা না করা, জাতীয় নিরাপত্তার একটি আঙ্গিক।
চার. মাত্র দুটি দেশ বাংলাদেশের সীমান্তের সঙ্গে লাগোয়াÑ ভারত ও মিয়ানমার। ভারতের সঙ্গে যাবতীয় তৎপরতা ঘঁষা-মাজা, গলাগলি, ওঠা-বসা, লেনদেন, লুকোচুরি ইত্যাদি চলছে, কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে বলতে গেলে কিছুই চলেনি। বাংলাদেশে সরকার, তৎপরতা চালালে বা না চালালে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কী হতে পারে বা কী হতে পারে না, এ নিয়ে সচেতন থাকার বিষয়টিও জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম আঙ্গিক।
পাঁচ. বাংলাদেশের সীমান্ত যদি কেউ লঙ্ঘন করে বা এ দেশের ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব যদি কেউ লঙ্ঘন করে, সেই লঙ্ঘনকারীকে কীরকম জবাব দেয়া উচিত ওই আলোচনা বা সচেতনতা, জাতীয় নিরাপত্তার একটি আঙ্গিক।
ছয়. মুসলিম বিশ্বের অঘোষিত নেতা বা নেতৃস্থানীয় দেশ সৌদি আরব। তার নেতৃত্বে অনেকগুলো দেশের একটি সামরিক জোট হয়েছে ছয় মাস বা নয় মাস বা এক বছর আগে। বলা হচ্ছে, এটা সন্ত্রাসবিরোধী জোট। বলা হচ্ছে, এটার সামরিক অধিনায়ক সৌদি আরব থেকে নিযুক্ত হবেন না; বলা হচ্ছে এই কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য জোটের সব সদস্যই বাস্তবে সশরীরে সামরিক অবদান রাখবেন। এই বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে কি হবে না, এই সচেতনতা বা এই আলোচনা জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক।
সাত. প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ফ্যাসিলিটি চাইল এবং বাংলাদেশ সরকার পানির দামে সেটা দিয়ে দিলো। এভাবে ট্রানজিট দেয়ার কাজটি ভালো কি মন্দ, এরূপ ট্রানজিট দেয়ার কাজটি বাংলাদেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য বা বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যের জন্য বা বাংলাদেশের সামরিক প্রস্তুতির জন্য বা আঞ্চলিক সামরিক সঙ্কটে বাংলাদেশের ভূমিকার জন্য উপকারী হবে না অপকারী হবে, এই সচেতনতা বা আলোচনা জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম আঙ্গিক।
আট. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী সশস্ত্রগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে, আলোচনা চালানো একটি অভিনন্দনযোগ্য কাজ। তবে আলোচনার পর বা আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীগোষ্ঠীকে কতটুকু ছাড় দেয়া হবে বা কতটুকু ছাড় দেয়া হবে না কিংবা কোন কোন বিষয়ে ছাড় দেয়া হবে এই সচেতনতা বা আলোচনা অবশ্যই, অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তার অলঙ্ঘনীয় আঙ্গিক। নয়. আরো অনেক উদাহরণ প্রদানযোগ্য। কলামের কলেবর সীমিত রাখার স্বার্থে আর উদাহরণ না দিয়ে আলোচনার পরবর্তী ধাপে যাচ্ছি।
জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা কয়েকটি দেশে
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তথা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। আমেরিকান সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার) তথা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল) পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে, তাদের প্রেসিডেন্টের (রিচার্ড নিক্সন) কাছে সুপারিশ করেছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য। ২০১৭ সালেও আমেরিকা সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল যেরূপ সুপারিশ করছে, মার্কিন সরকার ওইরূপ আচরণ করছে। আমেরিকান সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল অবশ্যই তাদের মাতৃভূমির, তাৎক্ষণিক স্বার্থ, অদূরভবিষ্যতের স্বার্থ এবং দূরবর্তী স্বার্থ বিবেচনা করেই এরূপ সুপারিশ করছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রতিবেশী, একটি আঞ্চলিক শক্তি যার নাম ভারত, একটি উদীয়মান সামরিক শক্তি যার নাম ভারত, তাদের দেশেও একটি নিরাপত্তা পরিষদ ব্যবস্থা কার্যকর রেখেছে। নরেন্দ্র মোদির আমলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হচ্ছেন অজিত দোভাল। তিনি পেশাগতভাবেই গোয়েন্দা বাহিনীর লোক। অজিত দোভাল পেশাগত দায়িত্ব পালনে জীবনে একনাগাড়ে অনেক বছর ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ছদ্মবেশে একজন দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে অবস্থান করে ভারতের গোয়েন্দা তৎপরতায় অবদান রেখেছেন বা জোগান দিয়েছেন। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা আছেন এবং একটি নিরাপত্তা পরিষদ আছে।
এমনকি, যাবতীয় উপদ্রব সৃষ্টিকারী আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারেও একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আছেন, যার নাম উ থাং টুন। পৃথিবীর বেশির ভাগ অগ্রগামী বা উন্নত দেশে এরূপ ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশে নেই। কেন নেই, সেই আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে; অনেকে অসন্তুষ্ট হবেন। এই মুহূর্তে এই কলামে সে আলোচনায় না যাওয়ার কারণ এই নয় যে, কে অসন্তুষ্ট হবেন বা হবেন না; বরং কারণ হলো আজকের কলামের ফোকাস অন্য।
বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যদি থাকতেন!
তবে কলামের এই অংশ থেকে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার আগে দৈনিক প্রথম আলোর গত ১৭ সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনামের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শিরোনামটি ছিল ‘রোহিঙ্গা-ঢলের আগাম তথ্য ছিল না : প্রস্তুতি নিতে পারেনি সরকার’। যদি বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ থাকত, যদি একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাকতেন, তাহলে সম্ভাবনা ছিল যে, সেই নিরাপত্তা পরিষদ অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে বা সরকারপ্রধানকে একাধিক বিষয়ে সজাগ রাখতেনÑ এক. মিয়ানমারের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের বিষয়ে। দুই. মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে বিভিন্ন তৎপরতা প্রসঙ্গে। তিন. বাংলাদেশে দুর্যোগ তথা বন্যা হয়েছে; তাই খাদ্য ঘাটতি হতে পারে, অতএব বিশ্বের খাদ্য উদ্ধৃত্ত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুত করার ব্যাপারে। চার. মিয়ানমার সীমান্তে সম্ভাব্য সশস্ত্র গোলযোগের প্রেক্ষাপটে বা গোলযোগের প্রতি উত্তর দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি বা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতির ব্যাপারে।
কলামের শিরোনামে ফিরে যাচ্ছি। পাঠকের সামনে যদি এমন কোনো মানচিত্র থাকে যেখানে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা-মিজোরাম-মনিপুর-নাগাল্যান্ড প্রদেশগুলো এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে একসঙ্গে দেখা যায়, তাহলে এই কলামের বক্তব্যটি বুঝতে সুবিধা হবে। রাখাইন প্রদেশের আগের নাম আরাকান। এই প্রদেশের ভূমি যেমন সমতল ও পার্বত্য এলাকার মিশ্রণ, তেমনি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও একটু ওপরে উল্লিখিত ভারতীয় প্রদেশগুলোর ভূমিও এইরূপ সমতল ও পার্বত্য এলাকার মিশ্রণ। প্রত্যেকটি এলাকায় তাদের দেশের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড বিদ্যমান। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, ১৯৪৭ সালে ভারতের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল; যেতে পারেনি। মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ (বর্তমান নাম রাখাইন প্রদেশ) ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল; থাকতে পারেনি। উত্তর-পূর্ব ভারতের দক্ষিণাংশের প্রদেশগুলো ভারতের সঙ্গেই থাকতে চায়নি, স্বাধীনতা চেয়েছিল; সম্ভব হয়নি। এই পুরো অঞ্চলটি অশান্ত এবং উপদ্রুত। ছোঁয়াচে রোগের মতো, এক এলাকার ঘটনা অন্য এলাকার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এখন থেকে ৮০-৯০ বছর আগে ব্রিটিশ-ভারতের শাসনকর্তারা এবং লন্ডনে অবস্থিত নীতিনির্ধারকেরা এ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। ইংরেজি ভাষায় লিখিত একটি পুস্তকের নাম লিখছিÑ ‘দি ফিউচার অব ইন্ডিয়া’; ১৯৪৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত। লেখকের নাম স্যার রেজিনাল্ড কুপল্যান্ড। ইংরেজি ভাষায় লিখিত আরেকটি পুস্তকের নাম দিচ্ছিÑ ‘দি নর্থ ইস্ট: রুটস অব ইনসার্জেন্সি’; কলকাতা মহানগরী থেকে ‘ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড’ কর্তৃক ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত; লেখকের নাম: প্রফুল্ল চৌধুরী। এই দুটি বইয়ের মধ্যে একটি বিষয়ে আলোচনা আছে।
তা হলো ‘কুপল্যান্ড প্ল্যান’ বা ক্রাউন কলোনি প্ল্যান। ১৯৩০-এর দশকে আসাম প্রদেশের গভর্নর স্যার রবার্ট রিড এবং স্যার রেজিনাল্ড কুপল্যান্ড কর্তৃক যৌথভাবে একটি প্ল্যান দেয়া হয়েছিল- ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত ত্যাগের সময়, ভারতকে চারটি মূল অঞ্চলে ভাগ করা হোক। অঞ্চলগুলো নিম্নরূপ: এক. সিন্ধু নদীর উপত্যকা বা দি ইনডাজ ভ্যালি; দুই. গঙ্গা নদীর উপত্যকা বা দি গেঞ্জেস ভ্যালি; তিন. দাক্ষিণাত্য বা দি ডেকান এবং চার উত্তর-পূর্ব ভারত নামে পরিচিত পার্বত্য এলাকা। কুপল্যান্ড এবং রিড উভয়ের যৌথ মত ছিল, যেহেতু এই পার্বত্য এলাকাটি আদতেই ভারতের না এবং বার্মারও না, তাই তাদেরকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়ে লন্ডনের ব্রিটিশ ক্রাউনের অধীনে রাখা হোক; তার নাম হবে ক্রাউন কলোনি। এই কলোনির দক্ষিণে থাকত তৎকালীন আরাকান ও তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তরে থাকত বর্তমানের ত্রিপুরা মনিপুর মিজোরাম নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল। উত্তর সীমান্ত হতো তৎকালীন ভারত ও চীনের সীমান্তরেখা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্ত হতো বঙ্গোপসাগরের নীল পানি। যা হোক, যেকোনো কারণেই হোক রেজিনাল কুপল্যান্ড এবং রবার্ট রিড এর পরিকল্পনা বা প্রস্তাব গুরুত্ব পায়নি; অতএব বাস্তবায়নও সম্ভব হয়নি। গুরুত্ব না পেলেও, এলাকার ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব কোনো মতেই কমেনি বরং দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
রাখাইনের গুরুত্ব ও রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশটি খুব ছোট নয়। এই প্রদেশের মাঝামাঝি এলাকায় এবং উত্তরাংশে রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠী বসবাস করে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখাইন প্রদেশ থেকে বের করে দিচ্ছে। গত ২ অক্টোবর মিয়ানমার থেকে আগত একজন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রসঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই কলাম লেখা শেষ করছি সোমবার ২ অক্টোবর রাত ৮টায় এবং পাঠক পড়ছেন ৪ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম মুহূর্ত থেকে নিয়ে অনলাইনে এবং সূর্যোদয়ের পর থেকে মুদ্রিত কপিতে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পারস্পরিক আলাপের সারমর্ম হলো, মিয়ানমার সম্মত হয়েছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে; উভয় সরকার একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করবে। বিস্তারিত দ্রুতই জানা যাবে। পাঁচ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে ছয় সপ্তাহের কম সময়ে এবং এখনো আসছে। যত দিন রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা চলবে; তত দিন রোহিঙ্গারা আসবে। তাদেরকে ফেরত নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত ওয়াদা আংশিক সন্দেহ এবং আংশিক স্বচ্ছতা নিয়ে গ্রহণ করছি। সন্দেহ এই যে, মিয়ানমার সরকার বিশ্ববাসীকে এবং বাংলাদেশ সরকারকে আপাতত ঠাণ্ডা করার জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এরূপ একটি ওয়াদা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে পাতলা প্রলেপ দেবে এবং সাফল্যের আভা ছড়াবে। এর পাশাপাশি আশা করব, নির্দিষ্ট কিছু ইতিবাচক শর্তসাপেক্ষে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে ফেরত যাবে; মিয়ানমার তাদের ফেরত নেবে। বাংলাদেশের মাটিতে অনেক বছরের মেয়াদে বা দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখার প্রসঙ্গটি জাতীয় নিরাপত্তার আঙ্গিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে হবে। মানবিক সহায়তা এবং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে সমন্বয় করতেই হবে।
আত্মসন্তুষ্টি লাভের কিছু নেই
কোনো মতেই কোনো অবস্থাতেই, আত্মসন্তুষ্টি লাভের কিছুই নেই। গত চার-পাঁচ সপ্তাহের বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ এবং কলাম যদি কেউ পড়ে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের, আলাদা আলাদা, আর্থিক ও কৌশলগত বিনিয়োগ সম্বন্ধে অবগত হয়েছেন। চীন ও ভারত কোনো অবস্থাতেই এমন একটি রাখাইন প্রদেশ চাইবে না, যেটা তাদের বিনিয়োগের প্রতি ও তাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। হুমকিবিহীন ‘শান্তশিষ্ট’ রাখাইন মানেই হলো, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীবিহীন রাখাইন প্রদেশ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীবিহীন করতে হলে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবেÑ এক. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মেরে ফেলতে হবে; দুই. তাদের বিতাড়িত করে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে এবং তিন. তাদের মনের মধ্যে এমন ভয় ঢুকাতে হবে, তারা যেন ফেরত আসতে না চায় এবং চাইলেও ফেরত এসে যেন দেহ ও মনে বৌদ্ধমনা হয়ে যায়। একই সঙ্গে, মিয়ানমার রাষ্ট্র রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের এবং অন্য মানুষগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেবে, তাদের গ্রামগুলোকে দুর্গের মতো করে সাজাবে, তাদের রাস্তাঘাটগুলোকে সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহারের উপযোগী করবে এবং চীন, ভারত ও মিয়ানমারের যৌথ হোক বা স্বতন্ত্র হোক, ভূ-কৌশলগত ও রণকৌশলগত ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তুলবে। যত পরিবর্তনই হোক না কেন, পাহাড়ের জায়গায় পাহাড় থাকবে এবং জঙ্গলের জায়গায় জঙ্গল থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ
ছলে-বলে-কৌশলে, সময় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদেরকে বহিষ্কার করা হবে বলে আশঙ্কা
বিস্তৃতভাবে বদ্ধমূল হয়েছে। বিশেষত ওই বাঙালি যারা ১৯৭৮ সাল থেকে নিয়ে ১৯৮২ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। তবে এই প্রসঙ্গে ভালো-মন্দ আলোচনা আজকে করব না। একটু আগেই সুপরিচিত শব্দগুলো লিখেছি- ছল-বল-কৌশল। এইরূপ ছল-বল ও কৌশল অবলম্বন ও প্রয়োগ করছে বাংলাদেশ সরকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশের কিছু এনজিও, বুদ্ধিজীবী এবং বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি অংশ। এইরূপ ছল-বল ও কৌশল প্রয়োগের অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি উদাহরণ হলো ভূমিবিরোধ নিষ্পন্ন কমিশন। আলোচনাটি আগামী সপ্তাহে থাকবে।