ভয়াল ২৯শে এপ্রিল , তাইন্দং, পানছড়ির অগ্নিকান্ড ও গণহত্যার শোকাবহ দিবস।

Related imageভয়াল ২৯শে এপ্রিল , তাইন্দং, পানছড়ির অগ্নিকান্ড ও গণহত্যার শোকাবহ দিবস।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৮৬ সালের এই দিনে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার তাইন্দং, দিঘীনালা এবং পানছড়িতে বসবাসরত বাঙালির জীবনে নেমে আসে নৃশংস, বীভৎস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় এক কালরাত্রি।

সেই ভয়াল ২৯শে এপ্রিল রাত ৯টা ১৫ মিনিটে সকল উপজেলায় একই সময়ে বর্বর শান্তি বাহিনী নিরস্ত্র নিরিহ শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের উপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেদিন পার্বত্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক নৃশংস ববর্বরতার ঘটনা।

ঐ দিন রাত ১টা পর্যন্ত মোট ৪ঘন্টা ব্যাপী খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তবর্তী মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং,তবলছড়ি ইউপি, পানছড়ি উপজেলা’র ১নং লোগাং ইউনিয়ন,৩নং পানছড়ি সদর ইউনিয়ন ও ৪নং লতিবান ইউনিয়ন (বর্তমানে ৫নং উল্টাছড়ি ইউপি)‘র বাঙ্গালি গ্রামে অগ্নি সংযোগসহ নির্বাচারে গণহত্যা চালায়। শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধা, বনিতা যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই হত্যা করেছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)‘র অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা।তৎ সময়ে বে-সরকারি হিসাবে মাত্র ৪ঘন্টা সময়ে নিরস্ত্র ও নিরীহ ৮ শত ৫৩ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে প্রায় ৫শত জনকে, অপহরণ ও গুম করা হয়েছে আরো কয়েক হাজার বাঙালিকে। ৬হাজার ২শত ৪০টি বাড়ি সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার।

সেই হামলায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনী’র সন্ত্রাসীরা এত গুলো মানুষকে হত্যা করতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি।হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে, জবাই করে, আগুনে পুড়িয়ে, শিশুদেরকে পায়ে ধরে গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে, বেনেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খোঁচিয়ে খোঁচিয়ে হত্যা করেছিল। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সে দিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তথাকথিত শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীরা।

চারদিকে ক্ষত বিক্ষত.ছিন্নভিন সারি সারি লাশের স্তুপ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল হতভাগ্য মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিংবা পোড়া হাড়গোড়,সেদিন হতবাক করেছিল পার্বত্য চট্রগ্রামের সাধারণ মানুষকে।

এ হত্যাকান্ডকে অনেকেই ৭১ সালের পাকিস্তানি বর্ববরতার সাথে মূল্যায়ন করে বলেছেন, সন্তু লারমার সেই হত্যাকান্ড মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বর্ববরতাকেও হার মানিয়েছে। বাঙালির রক্তে লালে লাল হয়েছিল সেই দিন চেঙ্গী,মাইনি এবং ফেনী নদীর পানি। স্বজন হারানোর কান্না পার্বত্যাঞ্চলের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। এসব গণহত্যার ঘটনা যারা স্ব-চোখে দেখেছে বা বেঁচে যাওয়া সাক্ষী এদিনের ঘটনার কথা মনে করলে আজও শিউরে উঠেন। এসব হত্যাকান্ড, লুটতরাজ এবং অগ্নীসংযোগের মাধ্যদিয়ে কি যে,নারকীয় তান্ডব সৃষ্টি করেছিল শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্রগ্রামে।

এ গণহত্যা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিবিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীরা গণহত্যা সংঘটিত করে।

এসব গণহত্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণহত্যা গুলো হচ্চে,ভূষণছড়ার ১৯৮৪ সালের গণহত্যা, লংগদু, পাকোয়া খালী ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বার গণহত্যা, ১৯৭৯ কাউখালি গণহত্যা, বেতছড়ি গণহত্যা, বানরাইবারী, বেলতলী, বেলছড়ি গণহত্যা, তাইন্দং, আচালং, গৌরাঙ্গ পাড়া,দেওয়ান বাজার, তবলছড়ি, বর্ণাল,রামছিরা,গোমতি গণহত্যা ,গোলকপতিমা ছড়া, মাইচ্যেছড়া, তারাবনছড়ি গণহত্যা, ভূষণছড়া গণহত্যা, পানছড়ি গণহত্যা,দিঘীনালা গণহত্যা, ২৯ এপ্রিল১৯৮৬, মাটিরাংগা গণহত্যা, কুমিল্লাটিলা, শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, সিংহপাড়া, তাইন্দং গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা, ২ জুলাই ১৯৮৬, ভাইবোন ছাড়া গণহত্যা,হিরাচর, শ্রাবটতলী, খাগড়াছড়ি,পাবলাখালী গণহত্যা,লংগদু গনহত্যা১৯৮৯, নাইক্ষ্যাছড়ি গণহত্যা,মাল্যে গনহত্যা, লোগাং গণহত্যা, নানিয়ারচর গনহত্যা,জুরাইছড়ি গণহত্যা এবং গুইমারাসহ প্রত্যেকটি বাঙ্গালি গ্রামে অগ্নিসংযোগ সহ লুটতরাজ, হত্যা, বাঙ্গালি নারীদের গণধর্ষণ ও পরে হত্যা করে নারকীয়তা সৃষ্টি করেছিলো সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনী। শান্তিবাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ড থেকে রেহায় পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও। এছাড়া আরো অনেক ঘটনা রয়েগেছে অজনা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’ কর্তৃক উল্লেখিত বর্বরোচিত, নারকীয় ও পৈশাচিক হত্যাকান্ড ছাড়াও আরো অসংখ্য বর্বরোচিত ঘটনা শিকার হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিরা। সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ‘এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও ববর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার নির্যাতিত, নিপিড়িত, অধিকার বঞ্চিত, অসহায়, নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙ্গালীরা আজও ভুলেনি খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি, দিঘীনালা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার সকল বাঙ্গালী গ্রামগুলোতে ২৯ এপ্রিলের সেই অগ্নিকান্ড ও গণহত্যার শোকাবহ দিনের কথা। কিন্তু কোন এক অলৌকিক কারণে বাঙালিদের উপর সন্ত্রাসীদের চালানো এসব নির্যাতনের চিত্র প্রচার মাধ্যমে তেমন স্থান পায়নি।

সে দিন ছিল না ফেসবুক, দুর্গম অর‌্যানের বাঙালিদের কাছে ছিলো না ক্যামেরা ও চিত্রধারনের কোনো মাধ্যম। যার কারণে এসব হত্যা যজ্ঞের বীভৎস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় চিত্র অনেকটা বিলীন হয়েগেছে।আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্যাতনকারী উপজাতিরা নিজেদের নৃশংসতার স্বরূপকে ঢেকে তিলকে তাল বানিয়ে দেশে-বিদেশে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে যাচ্ছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা অত্যাচারিত।

অপরদিকে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি,পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার থেকে বঞ্চিত বাঙালি জনগোষ্ঠী সরকার কর্তৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই গণহত্যা ও বাঙ্গালী সম্প্রদায়কে চরমভাবে নিধনের ণির্মম ইতিহাস আজও কোন বই ছাপা হয়নি। তাইতো ঢাকা পড়ে আছে সুবিধাভোগীদের কাছে। ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্মৃতির পাতায় অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। যারা আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মানবাধিকারের দোকান খুলে ব্যবসা করছেন,তাদের এসব ইতিহাস জানা জরুরি। নয়ত, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না কোন দিন।
৩২ বছর পরেও এই হত্যাকান্ডের বিচার হবে কিনা তা জানেনা স্বজন হারানো সেই মানুষগুলো। তবে তাদের স্বজনদের খুনী সন্তু লারমা যখন দেশের পতাকাবাহী গাড়িতে ঘুরে দেশ ও সরকার বিরোধী বক্তব্য প্রদান করেন তখন সেইসব স্বজন হারানো মানুষগুলোর বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই যেন করার থাকে না।

এই হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে নারকীয়তা সৃষ্টি করেছিলো ৩৮হাজার বাঙালির হত্যাকারী খুনি জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা ও উপজাতি সন্ত্রাসী হায়নারা। যদিও কোন শহীদ পরিবার এখনও পুর্নবাসিত হয়নি। দেয়া হয়নি যথাযথ ক্ষতিপূরণ। উল্টো হত্যাকারীদের দেয়া হয়েছে সরকারি চাকরি, টাকা পয়সা,ঘড়বাড়ি এবং সারাজীবন ঘরে বসে বসে খাওয়ার রেশন। মন্ত্রীর মর্যাদায় জাতীয় পতাকা বহন করা গাড়ি ও বাড়ি।



এ যেন শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানী। তিনটি উপজেলায় এক সাথে গণহত্যা পরিচালনা করে সন্তুরারমা পেলো পুরস্কার, আর লাল সবুজের পতাকার ইজ্জত রক্ষাকারী শহীদদের করা হল তিরস্কার! এটা মেনে নেয়া যায়? সন্তু লারমাকে দেয়া সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করে খুনি সশস্ত্র উপজাতি সন্ত্রাসীদের শাস্তির লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি গঠন করে এখনই সন্ত্রাসীদের বিচার নিশ্চিত করা উচিৎ। এসব গণহত্যার মূল কারণ হলো একটি জাতি গোষ্ঠী বা একটি সম্প্রদায়কে নির্মূল করণ প্রক্রিয়া। সেহেতু উপজাতি এসব সন্ত্রাসী বাঙালি নির্মূল করার লক্ষে এসব সাধারণ বাঙালি হত্যা করেছিল। সেক্ষেত্রে এটি পার্বত্য বাঙালি গণহত্যা দিবসের জাতীয় স্বীকৃতির দাবি রাখে।