অসমিয়াদেরও আগে বর্তমান আসামে বাঙালিদের বসবাস শুরু হয়।

অসমিয়াদেরও আগে বর্তমান আসামে বাঙালিদের বসবাস শুরু হয়।

ভারতের আসাম রাজ্যে ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেনস’ (এনআরসি)-এর প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর। সবাই যখন নতুন বছরকে বরণ করতে প্রস্তুত ছিল, তখন আসাম রাজ্যের বাঙালিরা দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। এ রাতই তাদের দুর্ভাগ্যের শেষ রাত নয়, নির্ঘুম রাতযাপনের সূচনা হিসেবেই একে দেখছেন বিশ্লেষকরা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ তালিকায় যাদের নাম নেই তাদের নাম থাকবে দ্বিতীয় তালিকায়, যদি তারা ভারতের প্রকৃত নাগরিক হয়ে থাকেন। সমস্যাটা এখানেই।

সমস্যার গভীরতা ও জটিলতা উপলব্ধির জন্য আসামের ইতিহাস ও ৪৭’র দেশভাগের ঘটনাবলির ওপর আলোকপাত করা দরকার। ১৮২৬ সালে আসাম ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে অসমিয়াদের দ্বারা শাসিত ছিল প্রায় ৬০০ বছর। খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আসাম রাজ্যের নাম ছিল কামরূপ। মুসলিম পর্যটকদের বর্ণনা ও পুরাণে এ নাম রয়েছে। আজও আসামের একটি জেলার নাম কামরূপ, যা প্রাচীন নামের স্মৃতিবহন করছে। ব্রিটিশরা ১৮৭৪ সালে সিলেট জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে। ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠন থেকে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ আসাম প্রদেশের অংশ ছিল।


ব্রিটিশরা আসামের বিপুল অনাবাদি জমিতে কৃষিকাজের জন্য ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে লোকজন নিয়ে যায়। আসামের সঙ্গে সিলেটের সংযুক্তি ও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে লোক স্থানান্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে আসামে বাঙালিদেরও বসবাস ব্যাপক হারে শুরু হয়। যদিও পঞ্চম শতাব্দী থেকেই আসামে (কামরূপ) বাংলার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের রাজ্যের পক্ষ থেকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পাবলিকেশন বোর্ড অব আসাম কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য কম্প্রিহেন্সিভ হিস্টোরি অব আসাম’-এ উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাসের এ বর্ণনা অনুযায়ী অসমিয়াদেরও আগে বর্তমান আসামে বাঙালিদের বসবাস শুরু হয়। অথচ আজ আসামের বাংলাভাষী নাগরিকদের বাংলাদেশি হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবের মধ্যে একটি ছিল অখণ্ড বাংলাকে স্বাধীন রাখা, পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের সঙ্গে এবং আসামকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা। জওহরলাল নেহরুর অসম্মতির কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। তখন বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করতে হয় এবং আসাম প্রদেশের অন্তর্গত সিলেটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় গণভোটের। গণভোটে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দিলে সিলেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলোও পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে দেয়া হবে বলা হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক গণভোটে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার পক্ষে ২,৩৯,৬১৯ ভোট এবং বিপক্ষে ১,৮৪,০৪১ ভোট পড়ে।


সিলেটবাসী ৫৫,৫৭৮ ভোটের সুনির্দিষ্ট ব্যবধানে পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ভোট দিলেও শর্ত অনুযায়ী করিমগঞ্জ, বদরপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে দেয়া হয়নি। ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও সিরিল র‌্যাডক্লিফ কেন জওহরলাল নেহরু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এ বিমাতাসুলভ আচরণ করল, তা নিয়ে ইতিহাসের অন্দরমহলে অনেক কথা চালু আছে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী এডউইনার সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক এবং র‌্যাডক্লিফের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্র ছোট হয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন। যে অঞ্চলের বাঙালিদের নিয়ে আসামের রাজনীতি আজ সরগরম সেই বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের পথ ধরে বাংলাদেশের অংশ থাকার কথা ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, শত শত বছরের আবাসস্থলে বসবাস করেও আজ তাদের ‘ভারতের প্রকৃত নাগরিক’ হওয়ার জন্য নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে।

একটা দেশ তার নাগরিকদের তালিকা করবে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। নাগরিক তালিকা প্রণয়নের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দাবিটি বাস্তবায়িত হচ্ছে বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি হিসেবে প্রচারণার মাধ্যমে। এখন একজন বাঙালি কীভাবে কোন দলিলের মাধ্যমে তাকে প্রকৃত ভারতের নাগরিক প্রমাণ করবে তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। আদালত যে প্রমাণাদি গ্রহণযোগ্য হিসেবে রায় দিয়েছে, সেগুলোও ভেরিফাই করবে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। তাই যে কারও যে কোনো দলিল অগ্রাহ্য হলে পরবর্তী সময়ে ভারতের উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার শেষ সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া বাঙালি জনগোষ্ঠীর আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কতটুকু সুযোগ প্রকৃত অর্থে থাকবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তালিকায় যাদের নাম থাকবে না তাদের কীভাবে বিতাড়ন করা হবে বা নাগরিক সমাজ থেকে কীভাবে আলাদা করা হবে, তা নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় তালিকার অপেক্ষা না করেই এখন প্রকাশ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে আসামের সচেতন উদার চিন্তার ব্যক্তিরা। আসামের শিলচরসহ বাঙালিপ্রধান এলাকার ৬৫ শতাংশ ভেরিফিকেশন শেষ হয়ে গেছে জানানো হলেও তালিকায় বাঙালিপ্রধান এলাকার মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষের নাম রয়েছে। তাই দ্বিতীয় তালিকায় কী থাকবে তা নিয়ে সচেতন নাগরিকরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছে না। যৌক্তিক কারণেই বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের উদ্যোগে আয়োজিত নাগরিক সভায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মতো আসামে লাখ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। আলোচনাসভার বক্তা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. তপোধী ভট্টাচার্যের নামও প্রথম তালিকায় নেই। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এ নাগরিক সভায় ড. তপোধী প্রশ্ন রাখে, মুখ্যমন্ত্রী সেনোয়াল কেন বলছে, তালিকায় যাদের নাম থাকবে না, তাদের মানবাধিকার কেড়ে নেয়া হবে না? এটি কিসের ইঙ্গিত করে তা-ও কি বলা লাগবে? এরপরও কি কেউ বলবে না, এনআরসি বাঙালি বিতাড়নের কৌশল? হিটলারের দ্বারা লাখ লাখ ইহুদি হত্যালীলা এবং ১৮৭৪ সালের আসাম প্রদেশের সঙ্গে সিলেটের অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গ টেনে শাসকদের উদ্দেশে সে প্রশ্ন রাখে- বাংলায় কথা বলা কি অপরাধ? আমাদের কি রোহিঙ্গা বানানোর অপপ্রয়াস চলছে? (দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ)।

ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সঞ্জীব দেবলস্কর তার এক নিবন্ধে আগের দিন লিখেছে, ‘যারা স্বীকার করে বাংলাভাষী আর বাংলাদেশি সমার্থক নয়, অসম রাজ্যটিতে অসমিয়া জনগোষ্ঠীর যেমন অধিকার, তেমনই বরাহি, মিচিং, কোচ, বড়ো, বাঙালি, কার্বি, ডিমাসা, মনিপুরিসহ অপরাপর জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার, এদের কণ্ঠস্বর আজ স্তিমিত, যারা যুক্তিতে বিশ্বাস করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে, এরা তো কোণঠাসা হয়ে আছে এ রাজ্যে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই অসম হল অসংখ্য জনগোষ্ঠী সমন্বিত একটি রাজ্য, এখানে নাগরিক বৈধতা নিরূপণের ভার কার হাতে দেয়া যেতে পারে এটি কঠিন প্রশ্ন; কিন্তু উগ্র অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদী চক্রের হাতে তো দেয়া যেতে পারে না, এ তো সহজ কথা। অথচ বাস্তবে তো তা-ই ঘটেছে। গণমাধ্যমে এবং সভা-সমিতিতে উচ্চগ্রামে তো এটাই ঘোষিত হচ্ছে, অসমে বাঙালিরা উড়ে এসে জুড়ে বসা জনগোষ্ঠী- কী হিন্দু কী মুসলমান।’

উগ্রবাদীদের রক্ষচক্ষুর ভয়ে আসামের সচেতন বিবেক আজ বাকহীন। দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গের ৩ জানুয়ারির সম্পাদকীয় কলামে এ অবস্থার বর্ণনা এভাবেই এসেছে- ‘কথা আছে বুকের ভেতর, কিন্তু মুখ খুলে কেউ কথা বলছে না। চারদিকে রক্তচক্ষুর শাসানি।’ উগ্রতা আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এভাবে সারা ভারতের বিবেকবান মানুষ জেগে উঠলে হয়তো আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বাঙালি খেদাও পণ থেকে পিছু হটতে পারে। নতুবা একসময় যে বাঙালিরা ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাহায্য করেছে, তাদের বড় একটি অংশ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রহীন হওয়ার উদ্বেগ নিয়ে ইতিমধ্যে উধারবন্দ থানার কাশিপুর দ্বিতীয় খণ্ডের বাসিন্দা হানিফ খান প্রথম নাগরিক তালিকায় নাম না দেখেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ আত্মহত্যার কারণ অস্বীকার করলেও হানিফের প্রতিবেশীরা বলেছেন, হানিফ তালিকায় নাম না থাকা নিয়ে অস্থির ছিলেন।

আসামের প্রতিবেশী বাংলাদেশের সিলেট জেলার মানুষও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। ঐতিহাসিক কারণে এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে রয়েছে অনেকেরই আত্মীয়তার সম্পর্ক। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মতো আসামের বাঙালিদের ঢল যদি কখনও সিলেটের দিকে আসে, তাহলে তা সামলানো কঠিন হবে। কাজেই শুধু সিলেটবাসী নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেরও সমস্যাটি নিয়ে ভাবা উচিত।