রামমোহন নয় , সতীদাহ প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলিমেরাই প্রথম আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন

রামমোহন নয় , সতীদাহ প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলিমেরাই প্রথম আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন
সনাতন সমাজে সব চেয়ে খারাপ এবং বর্বর প্রথা হিসেবে গণ্য হয়েছে সতীদাহ প্রথা। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে জোর পূর্বক স্বামীর সাথে চিতায় ভস্ম করা ছিল এই প্রথা।

ব্রাহ্মণদের হাত ধরেই এ প্রথা এসেছে কারণ ব্রাহ্মণরাই রীতি ও নীতি নির্দেশক। তবে ব্রাহ্মণদের সাথে পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয়ও জড়িত আছে বলে অনেক ইতিহাসবিদ মতামত ব্যক্ত করেছেন- তা না হলে হঠাত করে কেন এ প্রথা প্রকটভাবে চলে আসবে। ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় পরাজিত হওয়ার পর অন্তপুরের নারীরা শত্রুর হাতে দলিত-মথিত হওয়ার চেয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণকে বেছে নিত। এ ধরণের আত্মাহুতিকে জহর বলা হত।

সতীদাহ প্রথা বন্ধে ভারতীয় মুসলিমদের অবদানকে শুধু মুছেই ফেলার চেষ্টা করা হয়নি, রীতিমতো তা অস্বীকার করে উল্টোদিকে সতীদাহের দায় মুসলিমদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার হীন চেষ্টা করা হয়েছে!


গুপ্ত সম্রাজ্যের (খৃষ্টাব্দ ৪০০) আগে থেকেই ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল। প্রচীন সতীদাহ প্রথার উদাহারণ পাওয়া যায় অন্তর্লিখিত স্মারক পাথরগুলিতে। সবচেয়ে প্রাচীন স্মারক পাথর পাওয়া যায় মধ্য প্রদেশে, কিন্তু সব থেকে বড় আকারের সংগ্রহ পাওয়া যায় রাজস্থানে। এই স্মারক পাথরগুলিকে সতী স্মারক পাথর বলা হতো যেগুলো পূজা করার বস্তু ছিল [Shakuntala Rao Shastri, Women in the Sacred Laws – The later law books (1960)]। ডায়োডরাস সিকুলাস (Diodorus Siculus) নামক গ্রীক ঐতিহাসিকের খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের পাঞ্জাব বিষয়ক লেখায়ও সতীদাহ প্রথার বিবরণ পাওয়া যায় [Doniger, Wendy (2009). The Hindus: An Alternative History. Penguin Books. p. 611]। তাছাড়া, আলেক্সান্ডারের সাথে ভারতে ভ্রমণ করতে আসা ক্যাসান্ড্রিয়ার ইতিহাসবিদ এরিস্টোবুলুসও সতীদাহ প্রথার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে। খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৩১৬ সালের দিকে একজন ভারতীয় সেনার মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বপ্রণোদিত হয়ে সহমরণে যায় [Strabo 15.1.30, 62; Diodorus Siculus 19.33; "Sati Was Started For Preserving Caste" Dr. K. Jamanadas]। [সূত্র: উইকিপিডিয়া]

এগুলো ছাড়াও আরো অনেক লেখকের অনেক ধরণের বক্তব্য আছে। কাজেই সতীদাহ প্রথাকে ভারতবর্ষে মুসলিম বা ইসলামের আগমনের সাথে মিলিয়ে ফেলা অসৎ উদ্দেশ্য ও ডাহা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। সঙ্গত কারণে সতীদাহ প্রথা হিন্দু শাস্ত্রে আছে কি নেই, তা আলোচনার বাইরে রাখা হলো।

সতীদাহ প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলিমদের আইনানুগ অবদান
১. সতীদাহ প্রথা বন্ধের প্রথম সরকারি প্রচেষ্টা মুসলিমরা করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বপ্রথম এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। [L. C. Nand, Women in Delhi Sultanate, Vohra Publishers and Distributors Allahabad 1989]

২. মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হুমায়ূন স্থানীয় হিন্দুদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন। [Central Sati Act – An analysis by Maja Daruwala is an advocate practising in the Delhi High Court. Courtsy: The Lawyers January 1988. The web site is called “People’s Union for Civil Liberties”]


৩. অনেক সময় মুঘল প্রসাশন থেকে বিধবা মহিলাদের পেনশন বা উপহার দেওয়া হতো সতীদাহ না করার জন্য। [উপরের সূত্র দ্রষ্টব্য]

৪. শিশুদের এই প্রথা থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের সময় নিয়ম ছিল কোনো অবস্থাতেই যেসব মহিলাদের সন্তান আছে তাদের দাহ হতে দেওয়া হবে না। [XVII. “Economic and Social Developments under the Mughals” from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964. This page maintained by Prof. Frances Pritchett, Columbia University]

৫. সব থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়। ১৬৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রুল জারি করেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে মুঘল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশের কোথাও সতীদাহ ঘটতে সরকারি অনুমতি দেওয়া হবে না। ইউরোপীয় পর্যটকদের বর্ণনা অনুযায়ী সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষের দিকে সতীদাহ প্রথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু রাজাদের স্ত্রীরা ব্যতীত। [XVII. “Economic and Social Developments under the Mughals” from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964. This page maintained by Prof. Frances Pritchett, Columbia University]

ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা নিয়ে হিন্দু ধর্মের সংষ্কারে সৃষ্টি হয় শিখ ধর্ম যাতে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ। তার মানে ভারতে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের প্রথম অমুসলিম ভারতীয় পদক্ষেপটিও আসে ইসলামেরই প্রভাবে। খারাপকে খারাপ জানতে পারা অনেক বড় বিষয়, আর এই কাজটিই ভারতে ইসলাম করেছে। ইসলাম সবাইকে মুসলিম বানাতে না পারলেও ভারতের সার্বিক মূল্যবোধ তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সতীদাহ যে একটি চরম অমানবিক প্রথা, নিদেনপক্ষে এটা ভারতীয়দের বুঝাতে পেরেছে – শিখ ধর্মে সতীদাহ নিষিদ্ধ হওয়া তারই একটি বাস্তব প্রতিফলন।

বলা হচ্ছে হিন্দু সমাজ থেকে সতীদাহ প্রথা নির্মূল হয়েছে। এই দাবি পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা আধুনিক কালেও এর উদাহরণ পাওয়া যায়। তাই সঠিকভাবে বললে বলতে হবে, সময় ও পরিস্থিতির চাপে পড়ে সতীদাহ প্রথা প্রায় বন্ধ হয়েছে। কারণ, আগে থেকেই ব্রাহ্মণ স্কলার ও প্রভাবশালী হিন্দুরা এই প্রথা বন্ধের বিরুদ্ধে ছিল। শুধু তা-ই নয়, ধর্ম দিয়ে সতীদাহ প্রথাকে সমর্থনও করা হয়েছে। এও বলা হয়েছে যে, বিধবা নারীদের নির্বাণ লাভের জন্য সতীদাহ একটি পূণ্যের কাজ। দেখুন-

Brahmin scholars justified the practice, and gave reasonings as to how the scriptures could be said to justify them. Among them were Vijnanesvara, of the 12th-century Chalukya court, and the 13th century Madhvacharya.[129] They lauded the practice as required conduct in righteous women, and said that it was not to be considered suicide, which was otherwise variously banned or discouraged in the scriptures. They deemed it an act of peerless piety, which was said to purge the couple of all accumulated sin, guarantee their salvation, and ensure their reunion in the afterlife.[8] [সূত্র: উইকিপিডিয়া]

বাস্তবতা হচ্ছে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম বারের মতো পদক্ষেপ নেন সুলতান মুহাম্মদ তুঘলক। এর পর একে একে সম্রাট হুমায়ূন, আকবর, শাহজাহান, ও আওরঙ্গজেব সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেন।

কিন্তু সতীদাহ প্রথাকে যেহেতু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পূণ্যের কাজ মনে করা হয় সেহেতু এ'রকম একটি প্রথাকে অল্প সময়ে বা চাওয়া মাত্রই নির্মূল করা বাস্তবে সম্ভব নয়। তবে মুঘল সম্রাটরা ধাপে ধাপে এই প্রথা নির্মূলের কাজ অনেকটাই প্রশস্ত করেছিলেন। এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হয়েছিল। ইউরোপীয় পর্যটকদের বক্তব্য অনুযায়ী আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষের দিকে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত না হলেও একেবারে কমে যায়।

রামমোহন রায়ের আগ পর্যন্ত সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজ সংস্কারকদের কোনো রকম ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে মুসলিম শাসক এবং ইসলামের দর্শনের সংস্পর্শে থেকে সতীদাহ প্রথা প্রায় নির্মূলের পথে এসেছিল। অথচ কয়েক বছরের আন্দোলন প্রচেষ্টার জন্য রামমোহন রায় ও বৃটিশ গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-কে সতীদাহ প্রথা বন্ধের পুরো কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে! শত শত বছর ধরে যে প্রথা সমাজের মানুষের মন মগজে 'পূণ্যকর্ম চর্চা' বলে পালিত হয়ে আসছিল সেই প্রথা মাত্র কয়েক বছরে ব্যক্তি বিশেষের প্রচেষ্টায় নির্মূল হয়ে যাবে, সে কথা জ্ঞানপাপীরা দাবি করলেও বাস্তববাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে, রামমোহন রায় তার এক বৌদিকে জোরপূর্বক সতী বানানোর ঘটনা দেখে ১৮১২ সালের দিকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু করে। তার আগ পর্যন্ত হিন্দু সমাজ সংস্কারকদের মধ্য থেকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে কোনো রকম আন্দোলনের কথা শোনা যায় না। ফলে রাজা রামমোহন রায়ের সাথে সাথে আপামর হিন্দু সমাজ কোনোভাবেই এই প্রথা নির্মূলের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না – এককভাবে তো নয়-ই। এখনো সুযোগ দেওয়া হলে বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সতীদাহ প্রথা আবার শুরু হবে – বিশেষ করে ভারতে – কারণ, এই প্রথার পুনঃপ্রচলনে ও একে টিকিয়ে রাখতে ভারতীয় বর্ণ হিন্দুরাই ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী। তার প্রমাণ হচ্ছে ১৮২৯ সালের দিকে বৃটিশ শাসনামলে এই প্রথার বিরুদ্ধে পুনারায় আইন করা হলেও পরবর্তীতে সতীদাহের ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

অতএব, হিন্দু সমাজের এই বর্বর ও অমানবিক প্রথা উচ্ছেদে মুসলিমদের অবদানকে যারা পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলে উল্টোদিকে মুসলিমদের উপরই এর দায় চাপাতে চায় তাদের উচিত সঠিক ইতিহাসের দিকে পুনরায় ফিরে তাকানো। তাহলেই তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে যে, সতীদাহ প্রথা প্রচলনের সাথে মুসলিমদের কোনো রকম সম্পর্ক তো নেই-ই বরং এই প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলিমদের অবদান অনস্বীকার্য।