ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের সূত্রে জানা যায়, নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৮ সালে আর্থিক সংকটে পড়লে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকার থেকে ৩০ বছর মেয়াদে পরিশোধযোগ্য বার্ষিক শতকরা ৩ টাকা সুদে ১৪ লাখ রুপি ঋণ গ্রহণ করেন। সম্পাদিত বন্ধকি চুক্তি অনুসারে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে ৫ লাখ রুপি মূল্যের হীরকখণ্ড দরিয়া-এ নূর এবং আরও রত্নাদি ঋণদাতার বরাবর বন্ধক থাকে। সেই ১৪ লাখ রুপির সুদাসল অদ্যাবধি পরিশোধ করা হয়নি। ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানের একটি চিঠি উদ্ধৃত করে দৈনিকটিতে উল্লেখ করা হয়, দরিয়া-এ নূরসহ ১০৯ প্রকার রত্ন সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের ভল্টে রয়েছে। ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র অনুসারে আরও জানা যায়, ঋণের জামানত সম্পদগুলো ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন স্টেট ব্যাংকে জমা রাখা ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এখন জমা রয়েছে সোনালী ব্যাংকে। তবে এগুলো যথাযথভাবে আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে ভূমিমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে সে বছরেরই ৩ অক্টোবরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। আরও জানা যায়, ২০০৩ সালের ৩ মে নবাব স্টেটের বন্ধকি সম্পত্তি পরিদর্শনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছিল। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথি অনুসারে ২০১১ সালের ২১ জুন ভূমিমন্ত্রীসহ কমিটির সদস্যদের সামনে কাপড়ে মোড়ানো সিলগালা অবস্থায় একটি লোহার বাক্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষে এনে পরিদর্শন করা হয়। তবে এই সিলগালা খুলে হীরকখণ্ডটিসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ দেখা হয়নি। বাক্সটি ১১০ বছর ধরে আছে ব্যাংকের অন্ধকার ভল্টে।
কথা থাকে, এই মূল্যবান ঐতিহাসিক স্মৃতিসম্পদ দরিয়া-এ নূর অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখার কোনো সুযোগ আছে কি না। এ বিষয়ে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকও বলেছেন, হীরকখণ্ডটি ব্যাংকের ভল্টে বন্দী করে রাখার কোনো যুক্তি নেই। এটি শতাধিক বছর ব্যাংকে থাকায় এমনিতেই জাদুঘর পেতে পারে। এটা সেখানে নিতে তিনি ব্যর্থ প্রয়াসও চালিয়েছেন। তবে চেষ্টা এখনো চলছে। এটা রাখার মতো পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জাদুঘরে রয়েছে। তাহলে বিষয়টির কেন সুরাহা হচ্ছে না, এটা বোধগম্য নয়। প্রশ্ন হতে পারে, ঋণের টাকার সুরাহা না করে এর বন্ধককৃত সম্পত্তি কীভাবে বিলিবণ্টন করা যায়? সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন, ১৯০৮ সালে ধার নেওয়া ১৪ লাখ রুপি সুদাসলে বর্তমান মূল্যে কয়েক শ কোটি টাকা হয়েছে। হতে পারে। তবে এই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। আর জামানতও নেহাত ফেলনা নয়। বন্ধকি সম্পত্তি সময়ান্তরে ঋণ শোধ না করলে ঋণদাতারই হয়ে যায়। তাই দরিয়া-এ নূরসহ এসব রত্ন সরকারের হয়ে যাওয়ারই কথা। শুধু আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। কোনো আইনি বিপত্তি থাকলে তা কাটানোর ব্যবস্থাও অযাচিত হবে না।
আর নবাব সলিমুল্লাহর দেনা পরিশোধ! আইনত তিনি এবং তাঁর অবর্তমানে ওয়ারিশগণ দেনাদার, এটা অনস্বীকার্য। সরকার চাইলে ওয়ারিশদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থাও করতে পারে। অন্যদিকে যদি ঢাকার নবাব পরিবার, বিশেষত নবাব সলিমুল্লাহর শুধু ঢাকা শহর নয়, এই অঞ্চলের জন্য অবদান বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে বিনা বাক্যে এটা অবলোপন করা যায়। কয়েক শ কোটি টাকা এখন খুব বেশি টাকা নয়। কয়েক হাজার কোটিকেও তো সামান্যই বলা হয়। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে ঢাকা শহর গড়তে এই পরিবারের অবদান বহুমুখী। ঢাকায় প্রথম সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও টেলিযোগাযোগের ব্যবস্থা হয় তাঁদের পরিবারের অর্থানুকূল্যে। আহছানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (আজকের বুয়েট), মিটফোর্ড হাসপাতালসহ অনেক স্থাপনাতেই রয়েছে তাঁদের অবদান। ঢাকাসংক্রান্ত সব ঐতিহাসিক গবেষণাতেই রয়েছে এর স্বীকৃতি।
তবে নবাব সলিমুল্লাহর কার্যক্ষেত্রটি ছিল আরও বড়। তিনি দেখলেন, বঙ্গ প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ। অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে পারছে না। সেই বিবেচনা থেকে বাংলা ভাগ এবং নবসৃষ্ট পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় করার দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। তাঁর এই রাজনীতিকে বিবেচনা করতে হবে তখনকার সময় ও প্রেক্ষিত সামনে রেখে। সেই সময়ের জন্য এটা প্রাসঙ্গিক ছিল, এমনটাই লক্ষণীয়। এই দলটিতেই দেশ বিভাগ-পূর্বকালে আমাদের অঞ্চলে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেরেবাংলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর মাওলানা ভাসানী। সেই সময়ে তাঁদের হাত ধরেই সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। এই রাজনীতি ভুল ছিল, এমন কোনো কথা আমরা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখি না। শুনিনি তাঁর কোনো ভাষণে। তবে দেশ বিভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে একটি উপনিবেশের মতো ব্যবহার করতে থাকায় এখানেই সেই মুসলিম লীগারদের একটি অংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। গঠন করেন নতুন দল। এর অনেক আগেই নবাব সলিমুল্লাহ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বংশধরেরা বাঙালিদের প্রত্যাশার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে অক্ষম হন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অবস্থান নেন বিপরীতে। ফলে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান এই দেশের রাজনীতিতে। বঞ্চিত হন প্রাপ্য সম্মান থেকে। তাঁদের দিয়ে তো নবাব সলিমুল্লাহকে বিবেচনা করা যাবে না।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়। অন্যদিকে ১৯৪৭-এ সেই বঙ্গভঙ্গবিরোধীরাই বাংলাকে ভাগ করতে উঠেপড়ে লাগেন। কেমব্রিজ শিক্ষিকা স্বনামধন্য জয়া চ্যাটার্জির বাংলা ভাগ হলো বইটির ভূমিকায় ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ সম্পর্কে এক স্থানে লিখেছেন, ‘এই আন্দোলনে বাঙালি সমাজের সেই শ্রেণির লোকেরাই নেতৃত্ব দেয়, যারা বাংলার প্রথম বিভাগের সময় থেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিল, যাদের পরিচিতি ছিল তথাকথিত ভদ্রলোক বা সম্মানিত লোক।’ সুতরাং ১৯০৫ এবং ১৯৪৭ দুবারই বঙ্গভঙ্গ হয়েছে তখনকার বাস্তবতায়। এমন অবস্থায় নবাব সলিমুল্লাহর ভূমিকাকে ধরে নিতে হবে তিনি তাঁর সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবহেলিত অনুন্নত সম্প্রদায়ের বহুমুখী কল্যাণে সচেষ্ট ছিলেন।
এরপর আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। নবাব সলিমুল্লাহ প্রয়াত হয়েছেন ১৯১৫ সালে। তবে এর জন্য আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে ১৯১১ বাংলা ভাগ রদ হওয়ার পর থেকে। এর নেতৃত্বে ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ। ১৯১২ সালেই তাঁর নেতৃত্বে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ১৯১৩ সালে সরকার এই দাবি নীতিগতভাবে মেনে নেয়। এর পরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিলম্বিত হয় কার্যক্রম। পাশাপাশি কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালিদের একটি প্রভাবশালী অংশের বিরোধিতাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলো সবই ইতিহাসের বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার বিকাশ ঘটতে থাকে। অনগ্রসর শ্রেণি ক্রমান্বয়ে করে নিতে থাকে তাদের স্থান। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার বলা বোধ হয় অন্যায্য হবে না। আর এর প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের পুরোভাগেই ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ।
নবাব সলিমুল্লাহর ঋণের দায় সরকার মওকুফ বা অবলোপন করার ক্ষমতা রাখে। তাঁর বন্ধককৃত সম্পদের মালিকও রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে। এ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, জনসেবামূলক বিভিন্ন কাজ, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর যে অবদান, এটা বিবেচনায় নিলে কে কার কাছে ঋণী, সেই প্রশ্নও কিন্তু চলে আসে। বৃহত্তর পরিসরে বিবেচনা করলে আমরাই তো নবাব সলিমুল্লাহদের মতো আমাদের মহান পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণী। তবে আমাদের মধ্যে অকৃতজ্ঞ লোকও কম নেই। কিছু বাঙালিই জাতির জনককে সপরিবার হত্যা করেছে। তাঁর স্মৃতি মুছে দিতে সক্রিয় ছিল দীর্ঘকাল। কারাগারে হত্যা করেছে জাতীয় চার নেতাকে। দেশ-বিদেশে নন্দিত ব্যক্তিদের হেনস্তা করতে আজও আমরা সক্রিয়।
অবশ্য নবাব সলিমুল্লাহ এর অনেক আগের প্রজন্ম। তাঁর রাজনীতি ও সামাজিক কার্যক্রম ছিল তখনকার অবস্থার নিরিখে। এ ক্ষেত্রে ১১০ বছর আগে নেওয়া ১৪ লাখ রুপির সুদাসলের দায় থেকে সরকার তাঁকে মুক্ত করতে পারে। বন্ধককৃত দরিয়া-এ নূরসহ মণি-মাণিক্য সরকারের সম্পদ হিসেবে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যরূপে স্থান পেতে পারে জাতীয় জাদুঘরে। এখানে আইনি কোনো বিপত্তি থাকলে তা দূর করাও অসম্ভব নয়।