যে সুর্যসেন -প্রীতিলতাকে সিলেবাসে বিপ্লবী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তারা আদতে ছিলো উগ্র হিন্দু, মুসলিমবিদ্বেষি
৯ম-১০ম শ্রেনীর ২০১৮ এর 'বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা' বইয়ের ১০ম অধ্যায় 'ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন' ১৩৪-১৩৫ পৃষ্টায় সুর্যসেন-প্রীতলতাকে ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ তারা ছিলো তীব্র মুসলিমবিদ্বেষি ,উগ্র হিন্দু।
সূর্যসেনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো উগ্র হিন্দুত্ববাদ অনুসারে এবং তার কথিত বিপ্লবী দলের মূল অংশে কখনই কোন কোন মুসলমানকে নেয়া হতো না।
এ সম্পর্কে ইতিহাস বলে-.....সূর্যসেনদের এই ‘গান্ধীরাজ’ আর পণ্ডিত মদন মোহন মালব্যদের ‘রামরাজ্য ছিল সমার্থক। সূর্যসেনের সাথীরা ছিল গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহী সেনা’, আনন্দমঠের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রে উজ্জীবিত ও হিন্দু ভারতের স্বপ্ন-তাড়িত ‘সন্তান-সেনা’। যারা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছিল, যারা জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে সূর্যসেনের সাথী ছিল, তাদের মধ্যে একজনও মুসলমান ছিল না। (সূত্র: বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা: ২৪৩-১২৪৪; পূর্ণেন্দু দস্তিদার, স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, ১৪)
সূর্যসেনের দলের সদস্যদের উগ্রহিন্দুত্ববাদ দ্বারা আকৃষ্ট করা হতো।
....এ সম্পর্কে সূর্যসেনের দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শ্রী পূর্ণেন্দু দস্তিদার তার “স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম” গ্রন্থে লিখেছে: “তখন ধর্মভাব বিশেষ প্রবল ছিল। স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রধানত হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণীর ছাত্রদেরই তখন দলে আনা হত। ছাত্র ও যুবকদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতির জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, গীতা পাঠ, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বই ও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দ মঠ’ ইত্যাদি পড়ার ব্যবস্থা করা হত। (সূত্র পূর্ণেন্দু দস্তিদার, স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, পৃ ১৮)..
সূর্যসেনের দলের সদস্যদেরকে হিন্দু দেবী কালীর মূর্তির সামনে বুকের রক্ত দিয়ে পূজা করতে হতো। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘কারাস্মৃতি’ গ্রন্থে কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা লিখেছে:
“কিছুদূর গিয়ে এক মন্দিরের কাছে দু’জনে পৌঁছলাম। দরজা খোলাই ছিল। মাস্টারদা ও আমি ভেতরে ঢুকলাম। তারপর সে টর্চ জ্বালাল। দেখলাম ভীষণাননা এক কালী মূর্তি। মাস্টারদা একহাত লম্বা একখানা ডেগার বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল, মায়ের সামনে বুকের রক্ত দিয়ে পূজো কর। ওখানে বেলপাতা আছে। আমি বুকের মাঝখানের চামড়া টেনে ধরে একটুখানি কাটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হলো। তা বেলপাতায় করে মাস্টারদার কাছে নিয়ে গেলাম, সে বেশ স্পষ্ট করে বলল--মায়ের চরণে দিয়ে বল জীবনে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। আমি অসংকোচে মায়ের চরণে রক্ত আর মাথা রেখে এ প্রতিজ্ঞা করলাম।” (সূত্র:কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা: কারাস্মৃতি-১৯৭৪) ..
সূর্যসেন ‘কংগ্রেস’ দলের সদস্য ছিলো। সে ছিলো চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ১৯৩০ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনে মাওলানা মুহম্মদ আলী মুসলমানদেরকে কংগ্রেস হতে দূরে থাকার আহবান জানান। তিনি কংগ্রেসের আন্দোলন সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন- “গান্ধী উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিন্দু মহাসভার পক্ষে কাজ করছে। তার যাবতীয় কার্যক্রমের লক্ষ্য হলো হিন্দু রাজত্ব স্থাপন এবং মুসলমানদের পদানত করে রাখা।” (সূত্র: বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা: ২৪১) ....
উপরের দলিল দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় ঐ সময় মুসলমদের চরম বিরোধিতায় লিপ্ত ছিলো কংগ্রেস, যারা মুসলমানদের একঘরে করতে চাইছিলো। আর সেই কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক হচ্ছে সূর্যসেন। এখন সূর্যসেন কাদের পক্ষে কাজ করবে সেটা না বুঝার কোন কারণ নেই।
------------------------------------------------------------------------------
সূর্যসেনের কথিত বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধানটি বলতে হয় চট্টগ্রামের অস্ত্রগার লুণ্ঠন। এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করার জন্য বেছে নেওয়া হয় ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল তারিখটিকে।এই ১৮ই এপ্রিল তারিখে অস্ত্রগার লুট করাই প্রমাণ করে সূর্যসেন ছিলো চরম মুসলিম বিরোধী চক্রান্তবাজ। তার কথিত বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিমমুক্ত অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা।
কারণ ঐ দিন (১৮ই এপ্রিল, ১৯৩০) চট্টগ্রামে মুসলিম লীগ, জমিয়তুল ওলামা, মুসলিম যুব সমিতি ও মুসলিম শিক্ষা সমিতির এক যৌথ সম্মেলন শুরু হয়। সূর্যসেনের সাথে অস্ত্রগার লুট করার সময় যে ৬শ’ সন্ত্রাসী কাজ করে, যাদের প্রত্যেককে পরিধান করানো হয়, ঐ মুসলিম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মত পোষাক, তুর্কী টুপি। উদ্দেশ্য ছিলো অস্ত্রাগার লুটের পর সব দোষ পড়বে মুসলিমদের ঘাড়ে, এতে ব্রিটিশ বেঙ্গলে নিষিদ্ধ হবে মুসলিম রাজনীতি। উল্লেখ্য ঐ সময় কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করতে বেশি সক্রিয় ছিলো পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতারা। মূলতঃ তাঁদেরকে ফাঁসানোর জন্যই পরিচালিত হয়েছিলো মুসলিম পোষাকে সূর্যসেনের অস্ত্রাগার লুট। (সূত্র: খন্দকার হাসনাত করিম : সন্ত্রাসবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও ষড়যন্ত্রের শতবর্ষপূর্তি, দৈনিক ইনকিলাব, ২৩শে মার্চ ১৯৯৪; বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা: ২৪৬-২৪৬)
মুসলমানদের ফাঁসানোর চক্রান্ত করা হলেও, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায় উগ্রহিন্দুরা, বেচে যায় নিরীহ মুসলমানরা।
সূর্যসেনদের ‘বিপ্লব’ আর গান্ধীর অসহযোগ, স্বরাজ, আইন অমান্য আন্দোলন প্রভৃতি সবই ছিল এই হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই কারণেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক গান্ধী ও সূর্যসেনদের এই আন্দোলন তৎপরতাকে ‘গন্ডগোল’ বলে অভিহিত করেন। সূর্যসেনদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ১৭ দিন পর গান্ধী গ্রেফতার হলে এই বিষয়ের ওপর এক আলোচনায় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলেন:
“ভারতের ৭ কোটি মুসলমানের ৭০ জনও কংগ্রেসের সমর্থক নয়। মি গান্ধী যে রকম গন্ডগোল সৃষ্টি করেছেন তাতে তাকে গ্রেফতার করে রাখার জন্য আমি ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। (বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা: ২৪৬; ভারত কি করে ভাগ হলো, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ১০৯)
উপরের বিশাল আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়-
১) সূর্যসেন ও তার সঙ্গীরা কখনই অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো না, বরং মুসলিম বিরোধী উগ্রহিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো।
২) বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সূর্যসেনের সম্পর্কটা আসলে উল্টো। মানে সূর্যসেন হচ্ছে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) স্বাধীনতার সম্পূর্ণ বিরোধী।
৩) সূর্যসেনকে কমিউনিস্টরা নেতা হিসেবে মনে করে, এটা সম্পূর্ণ ভূল। কারণ সূর্যসেন কমিউনিস্ট ছিলো না, তবে তার অনুসারী উগ্রহিন্দুরা পরবর্তীতে এ অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো। তার অনুসারীই তাকে কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে প্রচার করে, যা এখনকার কমিউনিস্টরা বুঝতে পারে না।
৪) বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক স্থাপনার নাম সূর্যসেন/প্রীতিলতা নামে হয়। এটা একটা হাস্যকর বিষয়। ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তাদের নামে স্থাপনা তৈরী করলে যেমন বোকামি হবে, ঠিক তেমনি সূর্যসেন/প্রীতিলতা’র নামে স্থাপনা নির্মাণ করলেও ঠিক তেমন বোকামি ও হাস্যকর হবে। তাই সূর্যসেন/প্রীতিলতা’র নামে সকল স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা উচিত।