১০৯৫ খৃস্টাব্দ থেকে ১২৯১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড, বিষেশ করে বায়তুল মুকাদ্দাস খৃস্টানদের কর্তৃত্ব বহাল করার জন্য ইউরোপের খৃস্টানরা অনেক যুদ্ধ করে। ইতিহাসে এগুলোকে ক্রুসেড যুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এসব যুদ্ধ ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার ভূখণ্ডে ক্রসের নামে চালানো হয়েছিল। ক্রুসেড যুদ্ধের এই ধারা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। এ সময় নয়টি বড় যুদ্ধ হয় এবং তাতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়।
ফিলিস্তিন ও বায়তুল মাকাদ্দাস ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক রা.- এর সময়েই জয় হয়েছিল এবং তখন থেকে তা মুসলমানদের আয়ত্তে ছিল। দীর্ঘকাল পর্যন্ত খৃস্টানরা তা ফিরিয়ে নেয়ার কোনই দাবী তোলেনি। কিন্ত খৃস্টীয় একাদশ শতকের শেষদিকে সালজুকীদের পতনের পর হঠাৎ খৃস্টানদের মনে বায়তুল মাকদিস জয় করে নেয়ার চেতনা জাগে। তা থেকেই এ যুদ্ধের অবতারণা হয়। এসব যুদ্ধে ইউরোপীয়রা সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি, পক্ষপাতিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, অনৈতিকতা ও বর্বরতার যে প্রকাশ ঘটায় তা তাদের কপালে অনপনীয় কলঙ্ক হিসেবে চিরকাল থেকে যায়।
কারণসমূহ
ক্রুসেড যুদ্ধসমূহের পিছনে আসল কারণ ছিল ধর্মীয়। কিন্ত এটাকে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হয়। আর এই ধর্মীয় করণের পিছনে রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। যিনি এই যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়িয়ে ছিলেন সেই পিটার রাহেবের সম্পর্ক ছিল কিছু ধনী ইহুদীর সাথেও । পিটার রাহেব ছাড়াও ইউরোপে কয়জন খৃস্টান রাজার ধারণা ছিল ইসলামী এলাকাগুলো দখল নিতে পারলে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্তা কেটে যেতে পারে। মোটকথা, এসব যুদ্ধেও পিছনে কোন একটি কারণ ছিল না। তবে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্মীয় কারণ
ফিলিস্তিন হযরত ঈসা আ. এর জন্মস্থান। ফলে খৃস্টানদের জন্য তা পবিত্র ও বরকতময় স্থান। তাদের জন্য এটা ছিল পর্যটনের স্থান। হযরত উমর ফারুক রা.- এর খেলাফতকালে ফিলিস্তিন ভূমি ও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের অধীনে চলে আসে। বায়তুল মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল। বড় বড় অনেক নবীর কবর এখানে অবস্থিত। এ জন্য বায়তুল মাকদিস ও এ ভূমি মুসলমানদের কাছে খৃস্টানদের চেয়েও পবিত্র ও বরকতময় বলে বিবেচিত হয়। মুসলমানরা এখানকার বরকতময় জায়গাগুলো সব সময় হেফাজত করেছে। সেমতে অমুসলিম পর্যটকরা যখন তাদের পবিত্র স্থানগুলো দর্শনের উদ্দেশ্যে এখনে আসত, তখন মুসলমান প্রশাসনগুলো তাদেরকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করত। অমুসলিমদের গীর্জা ও খানকাগুলো সব ধরনের বিধিনিষেধের বইরে থাকত। প্রশাসন তাদেরকে উঁচু মর্যাদা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ইসলামী খেলাফতের পতন ও বিশৃঙ্খলার যুগে এসব পর্যটক স্বাদীনতার সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা চালায়। তাদের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতলবী আচরণের কারণে মুসলমান ও খৃস্টানদের মধ্যে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কিন্তু এই ধান্ধাবাজ ও একচোখা পর্যটকরা এখান থেকে দেশে ফিরে মুসলমানদের দুর্ব্যবহারের বানোয়াট কাহিনী প্রচার করত এবং ইউরোপবাসীকে উস্কে দিত। ইউরোপের খৃস্টানরা তো আগে থেকেই মুসলমানদের বিরোধী ছিল। এখন এ পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা আরো বেড়ে যায়। সেমতে খৃস্টীয় দশম শতকে ইউরোপের খৃস্টান রাষ্ট্রসমূহ ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংলেন্ড ইত্যাদি ফিলিস্তিন ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যাতে এটাকে আবার খৃস্টান সাম্রাজ্যের অন্তুর্ভুক্ত করে নেয়া যায়।
এ সময় গোটা ইউরোপে একটি গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, হযরত ঈসা আ. আবার নেমে এসে খৃস্টানদের সব দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। কিন্তু তাঁর অবতরণ হবে তখন, যখন জেরুজালেমের পবিত্র শহর মুসলমানদের হাত থেকে স্বাধীন করা হবে। এই গুজব খৃস্টানদের ধর্মীয় উত্তেজনা অত্যন্তু বাড়িয়ে দেয়ে।
খৃস্টান ধর্মগুরুরা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকেন যে, যদি কোন চোর, দুস্কৃতি ও পাপীও বায়তুল মাকদিস দর্শণ করে আসে, তাহলে পরকালে সে জান্নাতের উপযুক্ত হয়ে যাবে। এ জন্য বিশ্বাসের ভিত্তিতে বড় বড় দুস্কৃতিকারীও পর্যটক হিসেবে বায়তুল মাকদিস আসতে শুরু করে। এরা শহরে প্রবেশের সময় নাচ-গান ও শোরগোল করত নিজেদের প্রধান্য ও প্রসিদ্ধি প্রকাশ করার জন্য। আর শরাব পান করত খোলাখুলি। তাই পর্যটকদের এসব অশোভনীয় আচরণ এবং তাদের অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও শান্তিু শৃঙ্খলা নষ্টকারী কার্যকলাপের কারণে তাদের প্রতি কিছু নৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু এসব পর্যটক দেশে ফিরে মুসলমানদের কঠোর ব্যবহারের মনগড়া কাহিনী লোকদের শোনাতে থাকে, যাতে তাদের ধর্মীয় উত্তেজনা চাঙ্গা করা যায়।
খৃস্টানজাতি তখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একভগের সম্পর্ক ছিল পশ্চিম ইউরোপের গীর্জার সাথে। তাদের কেন্দ্র ছিল রোম। দ্বিতীয় ভাগের সম্পর্ক ছিল কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপল বা বর্তমানের ইস্তাম্বুল। দু’গীর্জার অনুসারীদের মধ্যে পরস্পরে বিরোধ ছিল। পশ্চিম ইউরোপ বা রোমের পোপ দীর্ঘকাল কামনা করেছিলেন- পূর্ব ইউরোপ বা বাইজেন্টাইন গীর্জার কর্তৃত্বও যদি পাওয়া যেত, তাহলে পুরো বিশ্বের খৃস্টান জাতির আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব তিনি পেয়ে যেতেন। সেমতে ইসলামের বিরোধিতা ছাড়াও তারা নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য তিনি ঘোষণা করে দিলেন, সারা দুনিয়ার খৃস্টানরা বায়তুল মাকদিস মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। এই যুদ্ধে যে মারা যাবে, সে জান্নাতের অধিকারী হবে, তার সব পাপ মুছে যাবে এবং বিজয়ের পর যেসব ধন দৌলত পাওয়া যাবে, তা তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। পোপের এ ঘোষণার ফলে সারা পৃথিবীর খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরোদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
পোপ দ্বিতীয় আরবান পশ্চিম ইউরোপের গীর্জার প্রধান ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানপূজারী ও যুদ্ধবাজ ধর্মীয় নেতা। ইউরোপের শাষকদের কাছে তার মর্যাদা ও গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। তাই তিনি নিজের মর্যাদা আবার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে খৃস্টনদের মধ্যে ধর্মীয় যুদ্ধের উম্মাদনা ছড়াতে শুরু করেন। তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে খৃস্টানদের প্রাধান্য ফিরিয়ে আনা ও মুসলমানদের পরাজিত করার প্রচারণা চালাতে থাকেন। তিনি গীর্জার প্রভার শক্তিশালী করার জন্য খৃস্টান বিশ্বে ধর্মীয় যুদ্ধেও আগুন জ্বলিয়ে দেয়াই উত্তম উপায় মনে করলেন। এভাবে তিনি ক্রুসেড যুদ্ধের পথ তৈরি করে দিলেন।
রাজনৈতিক কারণ
ইসলামের মুজাহিদরা তাদের উত্থানের যুগে বড় বড় সাম্রাজ্য নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন। আফ্রিকা, এশিয়া, আলজিরিয়া, ভূমধ্য সাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রসমুহ সাইপ্রাস, সিসিলি ইত্যাদি এবং স্পেন, পুর্তগাল- সবাই তাদের অধীনে চলে আসে। এভাবে সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু খৃস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ইসলামী বিশ্বের পরিস্থিতি অনেক বদলে যায়। মিসওর উবায়দী সাম্রাজ্য তখন পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সিসিলিতে মুসলমানদের শক্তি কমে গিয়েছে। স্পেনে যদি ইউসুফ ইবনে তাশফীনের আবির্ভাব না হতো, তাহলে সেখানে থেকে মুনলমানদের বিতাড়ন অনেক আগেই সম্পন্ন হতো। সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তি যখন কমে এসেছে, তখন খৃস্টান জগত তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে।
তুরস্কের সালজুকীদের যুগ ছিল মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির শেষ গৌরবময় অধ্যায়। তারা এশিয়া মাইনরের সব এলাকা জয় করে কুসতুনতুনিয়া জয়ের পথ খুলে দিয়েছিলেন। যদি মালিক শাহ সালজুকীর পর কোন উপযুক্ত ব্যক্তি সিংহাসনে আরোহন করতেন, তাহলে হয়ত কুসতুনতুনিয়া খৃস্টান বিশ্বের ওপর ইসলামী বাহিনীর হামলা প্রতিরোধের শেষ দুর্গ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। তাই সালজুকীদের শক্তিতে ভীত হয়ে বাইজেন্টাইন শাসক মাইকেল ডোকাস ১০৯০ খৃস্টাব্দে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে তুর্কিদের এই ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির প্রতি মনোযোগী করেন এবং তাদের কছে সাহায্য চান। সারা খৃস্টান বিশ্ব তার আহবানে তৎক্ষণাত সাড়া দেয়ে এবং ময়দানে নেমে আসে। এভাবে অল্পদিনের মধ্যে খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী স্রোতের বেগে ধেয়ে আসে মুসলমানদের প্রতি। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে প্রাচ্যের বাইজেন্টাইন গীর্জা ও পাশ্চাত্যের গীর্জার কধ্যে পরস্পরে সমঝোতা হয়ে যায় এবং উভয় গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড যুদ্ধে অংশ নেয়।
এদিকে ইসলামী বিশ্বে ছিল ঐক্যের অভাব। বাগদাদের আব্বাসী ও মিসরের ফাতেমী খেলাফত এবং সালজুকী ও স্পেনের শাসকেরা অধঃপতনের শিকার ছিল। তাদের মধ্যে ঐক্যের কোন পরিস্থিতি ছিল না। সুতরাং ক্রুসেডারদের জন্য এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর কী হতে পারত।
সামজিক কারণ
সামজিক দিক দিয়ে ইউরোপ ছিল মুসলমানদের তুলনায় পাশ্চাৎপদ। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের যেসব নীতি মুনলমানরা নিজেদের মধ্যে চালু করেছিল, ইউরোপের খৃস্টান সমাজ তখনো তা থেকে বঞ্চিত ছিল। অভাবী ও দরিদ্র লোকেরা বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধের জালে আবদ্ধ ছিল। সামন্ততন্ত্রের ওপর ইউরোপের সমাজব্যবস্থার ভিত্তি ছিল। সামন্ত প্রভুরা দরিদ্র জনসাধারণের রক্ত চুষে নিতে। অথচ তাদের কোন অধিকার পরিশোধ করত না। ক্ষমতাসীন ও ধর্মীয় গোষ্ঠী এসব মানুষের ক্ষোভের লক্ষ্য নিজেদের পরিবর্তে মুসলমানদের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। নৈতিক অধঃপতনের কারণেও জনসাধারণের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ইউরোপের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের দৃষ্টি অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলী ও তাদের দুর্দশা থেকে সরানোর জন্য বাইরের সমস্যাবলীর দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এসব লড়াইয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তাদের নিয়ে, যারা তাদের হীন তাড়না প্রশমিত করতে গ্রীক সৌন্দর্যের নান্দনিকতা স্পর্শ করার জন্য এ সফরে শরীক হয়েছিল। ফ্রান্সের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লেবরের বর্ণনায় সেই যুগের সামাজিক পরিস্থিতির সুন্দর প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি লিখেছেন- জান্নত লাভ ছাড়াও প্রতিটি মানুষ এটাকে সম্পদ লাভের উপায় বলে মনে করছিল। যেসব কৃষক ছিল জমিদারদের গোলাম, পরিবারের যেসব সদস্য আইনের দৃষ্টিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, যেসব ধনী ব্যক্তি অল্প সম্পত্তি পেয়েছিল এবং যারা সম্পদ উপার্জনের নেশায় পড়েছিল, যেসব পাদ্রী গীর্জার কঠিন জীবনরীতিতে হাঁপিয়ে উঠেছিল- মোটকথা দুর্দশাগ্রস্থ ও বঞ্চিত লোকদের একটি সংখ্যা এই পবিত্র বাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছিল।’ অর্থাৎ ধর্মীয় নেতারা তাদের বিলাসী জীবন লুকানোর স্বার্থে জনগণের মনোযোগ সামাজিক এসব আনাচার থেকে সরানোর চেষ্টা করেন।
অর্থনৈতিক কারণ
ইউরোপে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতো ইসলামী বিশ্বের স্বচ্ছলতা ও প্রাচুর্যের কথ। প্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলো স্বচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির যেসব পর্যায় অতিক্রম করেছিল, ইউরোপের দেশগুলো তা করতে পারেনি। সুতরাং ইউরোপের যেসব মহল সম্পদ উপার্জনের উপায় ইউরোপে খুঁজে পাচ্ছিল না, তারা তাদের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য এই ধর্মীয় অভিযানে অংশ নেয়। তাদের শুধু লক্ষ ছিল লুটপাট ও ধনসম্পদ অর্জন। হাঙ্গেরীর পথে অগ্রসর হওয়ার সময় সেখানকার খৃস্টন বাসিন্দাদের সাথে ক্রুসেডাররা যে আচরণ করেছিল, তা থেকেই এটা প্রমাণিত হয়।
ইউরোপের সরকার ব্যবস্থায় সামন্তপ্রতা ছিল মৌলিক বিষয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সামন্ত প্রথার অনিষ্টকারিতা ও কুপ্রভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অর্থের সমস্ত উৎস মহাজন, গীর্জার যাজক ও জমিদারদের আয়ত্তে ছিল। জনসাধারণ ছিল দুর্দশার মধ্যে। কৃষকদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। তাই ধর্মীয় শ্রেণী ধর্মের আচরণে জনগণের প্রতিক্রিয়া রোধ করার চেষ্টা চালায়, যাতে তাদের মনোযোগ দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর দিকে না যায়। তাছাড়া উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী যারা বঞ্চিত হয়েছিল, তারাও নিছক অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের স্বার্থে এতে বাতাস দেয়ে।
ইতালীর বাসিন্দারা চাইছিল ফিলিস্তিন ও সিরিয়া দখল করে আগের মতো নিজেদের ব্যবসায়িক উন্নতি সাধন করতে। কেননা ইসলামী বিজয়ের কারণে ইতালীর ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য তাদের ধারণা ছিল ক্রুসেড যুদ্ধের মাধ্যমে যদি ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার এলাকা সমূহ মুসলমানদের হাত থেকে আবার ছিনিয়ে নেয়া যায়, তাহলে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
তাৎক্ষণিক কারণ
তাৎক্ষণিক কারণ ছিল পোপ দ্বিতীয় আরবানের জিহাদের ফতোয়া। ফ্রান্সের পিটার যখন বায়তুল মাকদিস যিয়ারতে গেলেন, তখন তিনি বায়তুল মাকদিস ওপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব খুব কষ্টকর মনে করলেন। ইউরোপে ফিরে গিয়ে তিনি খৃস্টানদের দুরবস্থার সত্য মিথ্যা কাহিনী বর্ণনা করলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি গোটা ইউরোপ সফর করলেন। পিটারের এ সফর সেখানকার লোকদের মধ্যে ধর্মীয় উম্মাদনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। কিন্ত দুঃখের বিষয়, এই ধর্মযাজক বায়তুল মাকদিস দর্শন করতে আসা লোকদের দুস্কর্ম একদম চেপে গেলেন। পোপ যেহেতু পশ্চিমা গীর্জার আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন, এজন্য তিনি বিভিন্ন উপগোষ্ঠির একটি সম্মেলন ডাকলেন এবং সেখানে মুসলানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন। তিনি এ মর্মে সুসংবাদ ঘোষণা করলেন যে, এ যুদ্ধে মারা গেলে সব ধরনের পাপ মোচন হয়ে যাবে এবং বেহেশতের অধিকারী হওয়া যাবে। লোকেরা দলে দলে সেন্ট পিটারের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনে হামলার জন্য রওয়ানা দেয়ে।
প্রথম ক্রুসেড যুদ্ধ ১০৯৭-১১৪৫ খৃ.
পোপের যুদ্ধ ঘোষণার পর একে একে চারটি বিশাল সেনাবাহিনী বায়তুল মাকদিস জয়ের সঙ্কল্প নিয়ে রওয়ানা হয়। পাদ্রী পিটারের অধীনে তের লাখ খৃস্টানের এক বিশাল বাহিনী কনস্টান্টিনোপলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথে তারা নিজেদের ধর্মের লোকদের ওপরেই হত্যা, রাহাজানি ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। বুলগেরিয়া হয়ে তারা যখন কনস্টান্টিনোপল পৌছে, তখন এখানকার রোমান সম্রাট তাদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে তাদের গতি এশিয়া মাইনরের দিকে ফিরিয়ে দেন। তারা যখন ইসলামী এলাকায় প্রবেশ করে, তখন সালজুকী শাসক কালাজ আরসালান এ বাহিনীটিকে নাস্তানাবুদ করে দেন। তাদের প্রচুর সৈন্য নিহত হয়। ক্রুসেডারদের এ অভিযান একেবারেই ব্যর্থ হয়ে যায়।
ক্রুসেডারদের দ্বিতীয় বাহিনী একজন জার্মান পাদ্রী গাউসফেল- এর নেতৃত্বে রওয়ানা হয়। তারা যখন হাঙ্গেরী অতিক্রম করে, তখন তাদের অনাচারে হাঙ্গেরীর লোকেরা নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং তাদেরকে সেখান খেকে বের করে দেয়। এ বাহিনীটিও এভাবে অপকর্মের প্রয়াশ্চিত্ত ভোগ করে।
ক্রুসেডারদের তৃতীয় বাহিনীতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ফিনল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল। এ বাহিনী যখন পবিত্র যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হয়, তখন এই স্বেচ্ছাসেবকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শিকার হয় রাইন নদীর তীরবর্তী মোসেল সহ কয়েকটি শহরের ইহুদী বাসিন্দারা। এরা যখন হঙ্গেরী অতিক্রম করতে থকে, তখন হাঙ্গেরীর বাসিন্দারা তাদের কচুকাটা করে হাঙ্গেরীর মাটিকে তাদের কবরস্তান বানায়।
সবচেয়ে সুশৃঙ্খল ও বিশাল বাহিনী ছিল দশ লাখ সৈন্যের। ১০৯৭-এ তারা রওয়ানা হয়। এ বাহিনীতে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী ও সিসিলির রাজপুত্ররা ছিলেন। এ সম্মিলিত বাহিনির কমাণ্ড ছিল ফ্রান্সের গডফ্রের হাতে। বিশাল এই বহিনী এশিয়া মাইনরের দিকে রওয়ানা হয় এবং প্রসিদ্ধ কুনিয়া শহর অবরোধ করে। কালাজ আরসালান পরাজিত হলেন। বিজয়ী খৃস্টানরা অগ্রসর হতে হতে ইন্তাকিয়া পৌছে যায়। নয় মাস পরে ইন্তাকিয়াও তাদের দখলে চলে যায়। সেখানকার সমস্ত মুসলমানকে তারা হত্যা করে। মুসলমানদের ওপর ক্রুসেডারদের নির্যাতন ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়গুলোর একটি। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারল না। প্রায় এক লাখ মুসলমান নিহত হয়। ইন্তাকিয়ার পর বিজয়ী বাহিনী সিরিয়ার কয়েকটি শহর দখল করতে করতে হিমস পৌছে।
বায়তুল মাকদিস পতন
হিমস দখল করার পর ক্রুসেডাররা বায়তুল মাকদিস অবরোধ করে। ফতেমীরা বায়তুল মাকদিস শহর রক্ষার সন্তোষজনক ব্যবস্তা নেয়নি। এজন্য ১৫ জুন ১০৯৯ বায়তুল মাকদিস ওই ধর্মীয় উম্মাদরা সহজে দখল করে নেয়। শহরের পবিত্রতার কোনই খেয়াল করা হয়নি। মুসলমানদের গণহত্যা চালানো হয় এবং তাদের ধনসম্পদ লুটে নেয়া হয়। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরাও এই লজ্জাজনক অত্যাচারের কহিনী স্বীকার করেছেন। কয়েকশ বছর আগে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক রা. মুসলমানদের সাথে খৃস্টানদের আচরণ ছিল তার সম্পূর্ণ উল্টো। বায়তুল মাকদিসের আশপাশ এলাকা দখলের পর গডফ্রেকে বায়তুল মাকদিসের শাসক বানানো হয় এবং বিজিত এলাকাগুলো খৃস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। এসব এলাকার মধ্যে ছিল ত্রিপোলি, ইন্তাকিয়া ও সিরিয়ার অংশসমুহ। মুসলমানদের পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল মুসলমানদের পরস্পরে অনৈক্য বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা।
সালজুকীদের বিচ্ছিন্নতার মাঝখানে আবির্ভূত হন ইমাদুদ্দীন জঙ্গীর মতো মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি জঙ্গী শাসনের গোড়াপত্তন করেন এবং মুসলমানদেরকে নব জীবনে ফিরিয়ে আনেন। তিনি হারবান, হালাব ইত্যাদি এলাকা জয় করে নিজের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি যে সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ক্রুসেডারদের প্রতিহত করেন এবং তাদের পরাজিত করেন, তা ইসলামের ইতিহাসে গৌরবজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ইমাদুদ্দীন ইথারব দুর্গ ও মিসরের সীমান্ত এলাকা থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করে নিজেই দখল করে নেন। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রুসেডারদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয় এবং ইমাদুদ্দীন সিরিয়ার বৃস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেন। ইমাদুদ্দীনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বা লাবাক্কে আবার মুসলমানদের দখল প্রতিষ্ঠা।
দ্বিতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ ১১৪৪-১১৮৭ খৃ.
ইমাদুদ্দীনের ইন্তেকালের পর ১১৪৪ খৃস্টাব্দে তার যোগ্যপুত্র নূরদ্দীন জঙ্গী পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ক্রুসেডারদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে তিনি পিতার চেয়ে কম তৎপর ছিলেন না। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি মুসলমানদের মধ্যে জিহাদের নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করেন এবং খৃস্টানদের কাছ থেকে প্রচুর এলাকা ছিনিয়ে নেন। প্রত্যেকটি যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি ক্রুসেডারদের পরাজিত করতে থাকেন। রওহা শহরটি আবার মুসলমানদের দখলে চলে আসে। ক্রুসেডারদের পরাজয়ের খবর সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লে আবারো পোপ তৃতীয় কনরাড এবং ফ্রান্সের শসক সপ্তম লুইয়ের নেতৃত্বে নয় লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইউরোপ থেকে রওয়ানা হয়। এই বাহিনীতে নারীরাও ছিল। প্রথম ক্রুসেডের মতো এ বাহিনীর সৈন্যরাও অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। সপ্তম লুইয়ের বাহিনীর একটি বড় অংশ সালজুকীদের হাতে ধ্বংস হয়। তারা যখন ইন্তাকিয়ায় পৌছে তখন তাদের তিন চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অবশিষ্ট সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে দামেশ্ক অবরোধ করে। কিন্তু সাইফুদ্দীন জঙ্গী ও নূরুদ্দীন জঙ্গীর সম্মিলিত বাহিনীর প্রচেষ্টায় ক্রুসেডারদের পরিকল্পনা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। সপ্তম লুই ও কনরাডকে আবার ইউরোপের সীমান্তের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এভাবে দ্বিতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে যায়।
মিসরে নূরুদ্দীন জঙ্গীর দখর প্রতিষ্ঠা
ইতিমধ্যে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন হয় এবং ইসলামের ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে যার অসাধারণ কৃতিত্ব ও অবদান আজও মুসলমানদের জন্য শিক্ষণীয়। এ মহান ব্যক্তি ছিলেন গাজী সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। মিসরের ফাতেমী খলীফা ফায়েজ বিল্লাহর এমন ক্ষমতা ছিল না যে, তিনি খৃস্টানদের স্রোত প্রতিহত করবেন। তার মন্ত্রী শাদের সাদী ক্রুসেডারদের বিপদ অনুভব করে নূরুদ্দীন জঙ্গীকে মিসরে হামলার আহবান জানালেন। নূরুদ্দীন জঙ্গী নিজ ভাই আসাদুদ্দীন শিরকোহকে এ অভিযানে নিযুক্ত করলেন। সেমতে আসাদুদ্দীন মিসরে প্রবেশ করে খৃস্টানদের নাস্তানাবুদ করলেন। কিন্তু শাদের বিশ্বাস ঘাতকতা করলেন এবং শিরকোহের বিরুদ্ধে খৃস্টানদের সাথে আঁতাত করলেন। ১১২৭ খৃস্টাব্দে শিরকোহ আবার মিসরে হামলা চালালেন এবং আলেকজান্দ্রিয়া দখলের পর মিসরের অধিকাংশ এলাকা আয়ত্ত করে নিলেন। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী এসব অভিযানে শিরকোহের সহযোগী ছিলেন। শাদের সাদীকে অপরাধের কারণে প্রাণদণ্ড- দেয়া হয় এবং শিরকোহ হন খলীফা আজেদের মন্ত্রী। তারপর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী তার স্থলাভিষিক্ত হন। খলীফা তাকে আল মালিকুন নাসির উপাধী দেন। খলীফা আজেদের ইন্তেকালের পর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী মিসরে আব্বাসীয়দের নামে খুতবা চালু করেন। মিসরের স্বাধীন খলীফা হওয়ার পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদকে নিজ জীবণের লক্ষ সাব্যস্ত করেন।
হিত্তিন যুদ্ধ
মিসর ছাড়াও সালাহুদ্দীন ১১৮২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সিরিয়া, মোসেল, আলেপ্পো ইত্যাদি এলাকা জয় করে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তভূক্ত করেন। এ সময়ে ক্রুসেডার নেতা রিজনাল্ডের সাথে চার বছরের শান্তিচুক্তি হয়। সেমতে উভয়ে পরস্পরকে সাহায্য করতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু এ চুক্তি কাগজ কলমেই সীমিত থেকে যায়। ক্রুসেডাররা যথারীতি বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টিতে লিপ্ত থাকে এবং মুসলমানদের কাফেলার ওপর হামলা অব্যাহত রাখে।
১১৮৬ খৃস্টান রিজনাল্ড এমন ধৃষ্টতা দেখায় যে, আরো কয়েকজন খৃস্টান নেতাকে সাথে নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় হামলার উদ্দেশ্যে হেজাজে অভিযান চালায়। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী তার তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য পদক্ষেপ নেন এবং অবিলম্বে রিজনাল্ডকে ধাওয়া করতে করতে তাকে হিত্তিন গিয়ে ধরে ফেলেন। সুলতান সেখানে শত্রুবাহিনীর ওপর এমন এক আগ্নেয় উপাদান নিক্ষেপ করেন, যাতে মাটিতে আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগ্নেয় পরিবেশ ১১৮৭ খৃস্টাব্দে হিত্তিন সংঘটিত হয় ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলে তিরিশ হাজার খৃস্টান সৈন্য নিহত হয়। বন্দী হয় ওই পরিমাণে। রিজনাল্ড বন্দী হন। সুলতান নিজ হাতে তার দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করেন। এ যুদ্ধের পর মুসলিম বাহিনী খৃস্টানদের এলাকা সমূহে ছেয়ে ফেলে।
বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়
হিত্তিনে জয় লাভের পর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মনোযোগ দেন। এক সপ্তাহ ধরে রক্তক্ষয়ী পর খৃস্টানরা অস্ত্র ফেলে দেয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। ৯১ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস আবার মুসলমানদের আয়ত্তে আসে। বায়তুল মুকাদ্দাসের বিজয় ছিল সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। কিন্তু তিনি ক্রুসেডারদের মতো আচরণ করলেন না। তিনি খৃস্টানদের ওপর কোন প্রকার অত্যাচার নির্যাতন হতে দিলেন না। তাদেরকে তিনি চল্লিশ দিনের মধ্যে শহর ছেড়ে চলে যেতে অনুমতি দিলেন। দয়ালু সুলতান মুক্তিপণ হিসেবে নির্ধারণ করলেন মামুলি অর্থ। তাও যারা পরিশোধ করতে অপারগ হলো, তাদেরকে তিনি এমনিতেই মুক্তি দিলেন। কারো কারো মুক্তিপণ তিনি নিজের পক্ষ থেকে দিয়ে দিলেন। তখন থেকে প্রায় ৭৬১ বছর পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদেরই আয়ত্তে ছিল। তারপর ১৯৪৮ সালে এ যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ফ্রান্সের ষড়যন্ত্রে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতিষ্ঠা করা হয়ে। বায়তুল মুকাদ্দাসের অর্ধেক চলে যায় ইয়াহুদীদের দখলে। কিন্তু ১৯৬৭ এ আরব ইসরাইল যুদ্ধে বায়তুল মুকাদ্দাসের পুরো দখল নিয়ে নেয়ে ইসরাইল।
তৃতীয় ক্রুসেড
বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়া ক্রুসেডারদের জন্য মৃত্যুর পয়গামের চেয়ে কম ছিল না। মুসলমানদের এ বিজয়ের খবরে সারা ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফলে তৃতীয় ক্রুসেডের আয়োজন শুরো হয়। পুরো ইউরোপ এতে যোগ দেয়। জার্মান সম্রাট ফ্রেডারিক বারব্রোসা, ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস ও ইংল্যাণ্ডর রাজা রিচার্ডশেরদিল নিজেরাই এ যুদ্ধে অংশ নেন। পাদ্রী ও ধর্মযাজকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে খৃস্টানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন।
খৃস্টান বিশ্ব এত বিশাল সেনাবাহিনী আগে কখনো তৈরি করেনি। অসংখ্য সৈন্যের এ বাহিনী রওয়ানা হয়ে আক্কা বন্দর অবরোধ করে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী একাকী আক্কা বন্দর রক্ষার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। কিন্তু ক্রুসেডারদের কাছে ইউরোপ থেকে লাগাতার সাহায্য আসতে থাকে। এক যুদ্ধে দশ হাজার খৃস্টান সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু তবুও ক্রুসেডাররা অবরোধ বহাল রাখ। যেহেতু অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্র থেকে সুলতানের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো হলো না, এজন্য ক্রুসেডারদের অবরোধে শহরবাসীর সাথে হাত সুলতানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সুলতান সবরকমের চেষ্টা সত্ত্বেও মুসলমানদের কোনো সাহায্য পৌঁছাতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে শহরবাসীরা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে শহরটি খৃস্টানদের হাতে ছেড়ে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। সেমতে মুসলমানরা দু’লাখ স্বর্ণমূদ্রা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিশোধে সম্মত হয় এবং মহাক্রস ও পাঁচশ খৃস্টান বন্দীকে ফেরত দেয়ার শর্ত মেনে নিয়ে মুসলমানরা অস্ত্র ফেলে দেয়ে। মুসলমানদেরকে সব সহায় সম্পদ নিয়ে শহর থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু রিচার্ড বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং অবরুদ্ধ লোকদেরকে হত্যা করেন।
আক্কার পরে ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিনের আসকালান বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়। আসকালান পৌঁছানোর পথে সুলতানের বাহিনীর সাথে খৃস্টানদের এহার বারটি লড়াই হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আরসুভের লগাই। সুলতান বীরত্ব ও সাহসিকতার উজ্জ্বল নমুনা পেশ করেন। কিন্তু যেহেতু কোন মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ করে বাগদাদের খলীফার পক্ষ থেকে কোন সাহায্য এলো না, এজন্য সুলতানকে শেষ পর্যন্ত পিছপা হতে হলো। ফিরে আসার সময় সুলতান নিজেই আসকালান শহর ধ্বংস করে দিলেন। ক্রুসেডাররা যখন সেখানে পৌঁছল, তখন ইটের স্তুপ ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। এরই মধ্যে সুলতান বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষার সব আয়োজন সম্পন্ন করলেন। কেননা এবার ক্রুসেডারদের টার্গেট ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। সুলতান তার ছোট একটি বাহিনী নিয়ে খৃস্টানদের বিশাল বাহিনী অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করতে লগলেন। বিজয়ের কোন আশা দেখতে না পেয়ে ক্রুসেডাররা সন্ধির আবেদন জানায়। দু’পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। এরই মাধ্যমে তৃতীয় ক্রুসেড শেষ হয়।
এ ক্রুসেডে খৃস্টানরা আক্কা বন্দর ছাড়া আর কিছুই লভ করতে পারেনি। তারা বিফল হয়ে ফিরে যায়। রিচার্ড শেরদিল সুলতানের বদন্যতা, উদারতা ও বীরত্বে মুগ্ধ হন। জার্মান সম্রাট পালিয়ে যাওয়ার সময় নদীতে ডুবে মারা যান এবং এসব যুদ্ধে প্রায় ছয় লাখ খৃস্টান সৈন্য প্রাণ হারায়।
চুক্তির শর্তগুলো ছিল :
০১. বায়তুল মুকাদ্দাস যথারীতি মুসলমানদের হাতে থাকবে।
০২. আরসুভ, হায়ফা, ইরাফা ও আক্কা ক্রুসেডারদের হাতে চলে যায়।
০৩. আসকালান স্বাধীন এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
০৪. পর্যটকদের আসা যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
০৫. মহাক্রস যথারীতি মুসলমানদের আয়ত্তে থেকে যায়।
চতুর্থ ক্রুসেড (১১৯৫ খৃ.)
আইয়ূবী সুলতান আল মালিকুল আদেলের হাতে খৃস্টানরা দৃষ্টান্তমূলক পরাজয় বরণ করে এবং ইয়াফা শহর মুসলমানদের আয়ত্তে চলে আসে।
পঞ্চম ক্রুসেড (১২০৩ খৃ.)
ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনোপলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে।
ষষ্ঠ ক্রুসেড (১২২৭ খৃ.)
পোপ এনভিসেন্টের নেতৃত্বে আড়াই লাখ জার্মান সৈন্যের বিশাল বাহিনী সিরিয়ার উপকূলে আক্রমন করে। আইয়ূবী শাষক আল আদল নীলনদের মোহনায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। খৃস্টান বাহিনী নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।
সপ্তম ক্রুসেড
আল মালিকুল কামেল ও তার ভাইদের মধ্যে বিরোধের কারণে বায়তুল মুকাদ্দাস শহর ক্রুসেডারদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু কামেলের উত্তরসূরী সালেহ তা আবার ক্রুসেডারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেন। বায়তুল মুকাদ্দাস যথারীতি মুসলমানদের আয়ত্তে থেকে যায়।
অষ্টম ক্রুসেড
ফ্রান্সের সম্রাট নবম লুই মিসরে হামলা চালান। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান।
নবম ক্রুসেড
ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড ও ফ্রান্সের রাজা যৌথভাবে সিরিয়র হামলা চালান। মুসলমানরা ইংরেজ ফরাসী যৌথবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। এ যুদ্ধের ফলে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে ক্রুসেডারদের অস্তিত্ব নিশ্চিন্ন হয়ে যায়। ক্রুসেডারদের মধ্যে আর যুদ্ধের সাহস রইল না। এদিকে মুসলমানরা নিজেদের এলাকা রক্ষায় সচেতন হয়ে যায়।
নিজেদের দীর্ঘ যুদ্ধের ধারা শেষ হয় এবং খৃস্টানরা ধ্বংস ও পরাজয় ছাড়া আর কিছু অর্জন করতে না পারায় তাদের যুদ্ধের উম্মাদনা থিতিয়ে যায়। ক্রুসেড যুদ্ধসমূহের অবসান ঘটে।
অন্যান্য ক্রুসেড
এখনে যে নয়টি ক্রুসেডের বিবরন দেয়া হলো, তাছাড়া আরো কয়েকটি ক্রুসেড সংঘটিত হয়। সেগুলোও কম গুরুত্ব পূর্ণ নয়। যেমন ১২১২ খৃস্টাব্দে বালকদের ক্রুসেড নামে এক বিশেষ আয়োজন করা হয়। খৃস্টান পাদ্রীদের মতে বয়স্ক মানুষেরা পাপী হয়ে থাকে। পাপীরা থাকার কারণে ক্রুসেড বাহিনী জয় লাভ করতে পারছে না। যেহেতু বালকেরা নিস্পাপ হয়। অতএব যদি তাদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করা হয়, তাহলে বিজয় আসতে পারে। সেমতে ৩৭ হাজার বালকের এক বিশাল বাহিনী গঠন করা হয়। ফ্রান্স থেকে ৩০ হাজার বালকের বাহিনী রওয়ানা হয় সেনাপতি স্টিফেনের নেতৃত্বে। আর জার্মান থেকে নিকোলসের নেতৃত্বে রওয়ানা হয় ৭ হাজার বালক। কিন্তু এসব বালকের কেউ বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছাতে পারেনি। বরং ফ্রান্সের উপকূলয়ি এলাকা ও ইতালীতে তাদের সবাইকে গোলাম বানিয়ে নেয়া হয়। কিংবা তারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। কিংবা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে শেষ হয়ে যায়। বালকদের এ ক্রুসেড হয় পঞ্চম ক্রুসেডের আগে।
ইউরোপে উসমানী খেলাফতের সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে যেসব যুদ্ধ হয়, ইউরোপীয়রা সেগুলোকেও ক্রুসেড নাম দেয়।
১৪৫৬ খৃস্টাব্দে উসমানীরা বেলগ্রেড অবরোধ করলে তা ভাঙ্গার জন্য ইউরোপীয়রা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তখন উসমানী সুলতান ছিলেন কনস্টান্টিনোপল বিজয়ী মুহাম্মাদ। তিনি বেলগ্রেড জয় করতে সক্ষম হলেন না। ক্রুসেডাররাই বিজয়ী হলো। অবশ্য অনেক পরে ১৫২১-এর ২৯ আগস্ট সুলতান প্রথম সুলায়মান বেলগ্রেড জয় করে উসমানী সাম্রজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন।
ফলাফল
দু’শতাব্দী ধরে চলতে থাকা যে ক্রুসেড যুদ্ধ মুসলমানদের উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাতে ধ্বংস ও নাশকতা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেনি ইউরোপীয়রা। এভাবে এই ধর্মীয় উম্মাদনা
প্রথমত: অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ও ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণ হয়। এসব যুদ্ধ ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়ার জন্য। কিন্তু তা যথারীতি মুসলমানদের দখল থেকে যায়।
দ্বিতীয়ত: খৃস্টান ও মুসলমানদের মাঝখানে বৈরিতার মজবুত দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তা বহাল আছে। দু’ধর্মের মানুষের মধ্যে স্থায়ী বিরোধের পিছনে রয়েছে এসব যুদ্ধ। বর্তমানে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও নতুন বিশ্বব্যবস্থার নামে গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পশ্চিমা ও মার্কিন পরিকল্পনা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
তৃতীয়ত: ইউরোপের যুদ্ধের উম্মাদনা যখন থেমে যায়, তখন তারা গীর্জাগুলোর প্রভাব ও কর্তৃত্ব অনুধাবন করতে পরে। ফলে গীর্জার কর্তৃত্বের সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যাতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে গীর্জার প্রভাব কমে যায়।
চতুর্থত: ইউরোপের অসভ্য লোকেরা যখন মুসলমানদের সংস্পর্শে আসে, তখন মুসলমানদের শিক্ষা ও সভ্যতার উন্নতি দেখে অভিভূত হয়ে যায়। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের কারণে তাদের মানসিকতায় বিপ্লব সৃষ্টি হয় এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার জন্য ইউরোপের পরিবেশ অনুকূল হয়ে যায়। তাছাড়া ইউরোপে সামন্ত প্রথার অবসান ঘটে এবং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
পঞ্চমত: ইউরোপে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য লেনদেনের পরিবর্তে মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়। তাছাড়া শিল্প ও কারিগরি ক্ষেত্রেও ইউরোপে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ইউরোপের স্থাপত্য শিল্পও ইসলামী স্থাপত্য রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।