প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রিনে গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী। এই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন আতাউল গণি ওসমানি। তার পরেই ছিলেন ১১জন সেক্টর কমান্ডার। যাদের সবাই ছিলেন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর প্রশিক্ষিত অফিসার। এটাই বাংলাদেশ সরকার এবং সর্বজন স্বীকৃত ও অনুমোদিত মুক্তিবাহিনী। এই বাহিনীর বাইরে প্যারালাল আরেকটি বাহিনী গোপনে তৈরি করেছিল ইন্ডিয়া। সেটার নাম ‘মুজিববাহিনী’।যা শেখ সাহেবের অগোচরেই হয়েছিলো। এই বাহিনীর গড়ে উঠেছিল সম্পুর্নভাবে ‘র’-এর তত্ত্বাবধানে। মুজিব বাহিনীর গঠন করা হয় প্রবাসী সরকারকে না জানিয়ে। অত্যন্ত গোপনে। টেনিং ও সমন্নয়ের দায়িত্বে ছিল ইন্ডিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স বিভাগের প্রধান জেনারেল ওভান।
মুজিব বাহিনী প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বাহিনী বা মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চীপ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার লিখেছেন-‘১৯৭১ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ বাহিনী বা মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনী অস্থায়ী সরকারের দ্বারা অনুমোদিত ছিল। এই বাইরেও কিছু বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ব্যাক্তির নেতৃত্বে। তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে সমন্বয় করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। মুজিব বাহিনীর গঠনপ্রাণলী ছিল সম্পুর্ন আলাদা। এই বাহিনীর সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষক ছিল ‘র’-এর কাউন্টার ইন্ডিলিজেন্স বিভাগের মেজর জেনারেল সুজন সিং ওভান। ইন্ডিয়ার দেরাদুনে মুজিব বাহিনীকে গোপনে টেনিং দেওয়া হত। প্রথম দিকে প্রবাসী সরকার এবিষয়ে কিছুই জানত না। পরবর্তিতে বিষয়টি জানার পর প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবিষয়ে প্রবাসী সরকারকে পাত্তাই দেয়নি’ (ভেতরে বাইরে, পৃষ্ঠা-১৩২)।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ, সিরাজুল আলম খান-দর্শন ও চিন্তাধারা’ শীর্ষক একটি বই বাজারে পাওয়া যায়। এই বইয়ের ৯৯ পৃষ্ঠায় জেনারেল ওভানের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যায় রয়েছে ‘মুজিব বাহিনী’ শিরোনামে। এই অধ্যায় থেকে জানা যায় মুজিব বাহিনীর গঠনে ‘র’এর সার্বিক সহযোগিতায় ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ (বর্তমানে মন্ত্রী) ও আবদুর রাজ্জাক (মরহুম আওয়ামী লীগ নেতা)। শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নিহত হয়েছে। সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার পর থেকে পর্দার আড়ালে বহু ঘটনার নায়ক। তবে এক সময় তিনি তুখোর ছাত্রনেতা ছিলেন।
বইটিতে সিরাজুল আলম খানকে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চিন্তা এবং ভাব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এমনটাই দাবী করা হয়। যদিও স্বাধীনতার পরপরই শেখ ফজলুল হক মনি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর দূরত্ব তৈরির কথাও বলা হয় বইটিতে। তবে বইটি পাঠ করলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় শেখ মুুজিবুর রহমানের অজান্তেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘নিউক্লিয়াস’। পরবর্তিতে এই সংগঠনটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই গোপন সংগঠনের সদস্যরাই মূলত বেশি যোগ দিয়েছিল মুজিব বাহিনীতে। এই বাহিনীর তৎকালীন দ্বিতীয় সারির নেতা ছিল হাসানুল হক ইনু।
মুজিব বাহিনী গঠনের উৎস পাওয়া যায় ডা. কালিদাস বৈদ্যের লেখায়। কলিকাতা থেকে প্রকাশিত কালিদাস বৈদ্যের লেখা বইটির নাম হচ্ছে- "বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব"। এ বইয়ের ১৫৮ পৃষ্ঠায় শুরু হয়েছে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি অধ্যায়। এখানে বলা হয়েছে মুজিব বাহিনী কালিদাস বৈদ্য এবং চিত্ত রঞ্জন সূতারের ব্রেইন চাইল্ড। বইটির এ অধ্যায়ের শুরুতে ডা. কালিদাস বৈদ্য দাবী করে মুক্তি বাহিনীর প্যারালাল আরেকটি বাহিনী গঠন করতে সে এবং চিত্তরঞ্জন সূতার আলোচনা করে। তারা ধারণা করেছিল মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও তাদের আসল উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সংস্কৃতি বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। তারা মনে করত মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে যারা রয়েছে তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত। মুসলমানদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত এই বাহিনী। সুতরাং তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকতার নামে হিন্দু সংস্কৃতি ভাব প্রসূত পৃথক বাহিনী দরকার। যাদের হাতে থাকবে মূল ক্ষমতা।
এ অধ্যায়ের প্রথম প্যারার শেষাংশে উল্লেখ করা হয়-’চিত্তবাবু ও আমি গোপন আলোচনায় বসি। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সেই পথের অনুসন্ধানই ছিল আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়। সেদিনের আলোচনায় দুটি পথের কথা আমরা চিন্তা করি। তার প্রথমটি হল হিন্দু ছেলেদের আলাদাভাবে গোপনে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা। আর দ্বিতীয়টি হল মুক্তিবাহিনী ছাড়াও আরও একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বাহিনী গঠন করা। তারা একদিকে যেমন উন্নত ধরনের সামরিক শিক্ষা পাবে তেমিন অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার জন্য তাদের বাস্তব শিক্ষা দিতে হবে। এই অসাম্প্রদায়িক বাহিনী বাংলাদেশের প্রকৃত সামরিক ক্ষমতা তাদের হাতে নিবে। বাংলাদেশকে তারাই চালাবে সাম্প্রদায়িক মুক্তিবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করে।’ কালিদাস বৈদ্য বাবু প্রসঙ্গটি বর্ণনা করেছে মুজিব বাহিনী গঠনের নেপথ্য কাহিনী বলতে গিয়ে।
এ প্রসঙ্গে সে আরো বলেছে-‘বৈঠক শেষে চিত্ত বাবু প্রস্তাব করে, এই বাহিনীর নাম হবে মুজিব বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে আমি তার স্বীকৃতি জানাই। ওদিন আরো আলোচনা হয় মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব ও কতৃত্ব থাকবে ৪ জন ছাত্র নেতার হাতে।’
আলোচনায় তারা সিদ্ধান্ত নেন প্রথমে সিরাজুল আলম খানের সম্মতি পেলেই ৪ ছাত্র নেতার সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। তারা আরো ধারণা করল শেখ ফজলুল হক মনি কখনো তার মামার নামে গঠিত বাহিনীর বিরোধীতা করবে না। শেখ ফজলুল হক মনি এবং সিরাজুল আলম খান একমত হলে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ কোন বিরোধীতা করবে না। তাদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় চিত্ত বাবু ওই চার ছাত্র নেতার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে। বইটির বর্ণনায় বলা হয়, চিত্তবাবু বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার এক ফাঁকে প্রসঙ্গটি সিরাজুল আলম খানের সামনে উপস্থাপন করে। দেরি না করে সিরাজুল আলম খান তা লুফে নেন। তারা টার্গেট অনুযায়ী সিরাজুল আলম খানকে ব্যবহার করে বাকী ৩জনের সম্মতি আদায় করে।
কালীদাস বৈদ্যের বর্ণনায় আরো উল্লেখ করা হয়, ওই সিদ্ধানের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির মাধ্যমে পরের দিনই ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে পৌছে দেয়া হয়। সেও শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। তারপরই জেনালে ওভানের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি গোপনে মুজিব বাহিনী গঠন ও ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। এ বাহিনী গঠনের নেপথ্য কারন হিসাবে আরো কিছু বিষয় খোলাসা করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নিজেরা রেষারেষি করতে থাকবে। সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সাথেও মতানৈক্য চলবে। হিন্দু জোয়ানদের দিয়ে আরো একটি বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিবে তারা। এই বাহিনী হবে তখন মধ্যশক্তি বাহিনী। তাদের কথাই হবে তখন শেষ কথা।
মুজিব বাহিনী গঠন ও টেনিং নিয়ে কালীদাস বৈদ্য এবং এ কে খন্দকারের লেখায় হুবহু মিল পাওয়া যায়। এছাড়া সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখা বইয়েও একই তথ্য উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ইন্ডিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার প্রচেষ্টা নুতন কিছু নয়। এটা অতীতের ধারাবাহিকাত মাত্র। নিকট অতীতেও রাজনীতিতে ‘র‘-এর ভুমিকা নিয়ে এক তরফা অভিযোগ করা হত। এখন উভয় দিকেই তীর ছোড়া হচ্ছে। অতীত এবং বর্তমানের ব্যবধানটা এখানেই।