সু চির সরকারের অবস্থান আর ভিরাথুর অবস্থানের মধ্যে আর কোনো ফারাক নেই
মূল উদ্দেশ্য ছিল সু চি ভোট রাজনীতির মাঠে নামার আগেই বার্মার রাজনীতির অভিমুখ বেঁধে দেয়া; ইসলামবিদ্বেষী এক ‘চরম উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ’ ছাড়া অন্য রাজনীতি চলতে না দেয়া, এই রাজনীতি করতেই সু চিসহ সবাইকে বাধ্য করা। এই কাজে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটা বড় অংশকে সামরিক বাহিনী নিজে সংগঠিত করেছিল। বাহিনীর নিজ দল টঝউচ এর মাধ্যমে এদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করত।
ভিক্ষুদের এই সংগঠনের নামও দেয়া হয়েছিল; প্রথমে সামাজিক সংগঠন হিসেবে এর নাম ছিল ‘কমিটি ফর প্রটেকশন অব ন্যাশনালিটি অ্যান্ড রিলিজিয়ন’। আঞ্চলিক ভাষায় যার নাম ‘মা বা থা’। পরে রাজনৈতিক দল হিসেবে এর রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়েছিল। আত্মপ্রকাশের সময় এই সংগঠন দাবি করেছিল ‘রেস ও রিলিজিয়ন’ সম্পর্কিত (মুসলমানদের বিরোধী) চারটা আইনের খসড়া তৈরি করে তারা তা সংসদ থেকে পাস করিয়ে আনতে অনুরোধ করবে। সাবেক জেনারেল থেইন সেইনের হাত দিয়ে জেনারেলরা USDP নামে রাজনৈতিক দল খুলেছিল, দলের সভাপতিও ছিলেন তিনি, ২০১০ সালের তথাকথিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি; আর রাজনৈতিক সংস্কারগুলোও হয়েছিল তার হাতে। তিনিই মা বা থার প্রস্তাবিত চার আইন সংসদে পেশ করেছিলেন।
আইনগুলো হলো : ১. (মূলত মুসলমানদের নিগৃহীত করতে) ধর্ম বদল করতে হলে আগে রেজিস্ট্রেশন ও অনুমতি নিতে হবে। না হলে জেল ও জরিমানা করা হবে। ২. (একইভাবে মুসলমানদের জন্য করা) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোনো প্রদেশের সরকার যদি মনে করে, তার কোনো জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা অন্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যার তুলনায় ভারসাম্য ছাড়িয়ে গেছে, ফলে তুলনামূলক বেশি সামাজিক সম্পদ ভোগ করছে, তখন এ ক্ষেত্রে সাম্য আনার জন্য প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রকে ব্যবস্থা নিতে বলবে এবং কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে। (ভারতে বিজেপি-শিবসেনার মতো এটা একই আর্গুমেন্ট যে, মুসলমানেরা বেশি জন্মগ্রহণ করে।) ৩. আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিষিদ্ধ করতে হবে। ৪. বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে হবে।
এই চার আইনের মধ্যে প্রথম দু’টি ইতোমধ্যে সংসদে অনুমোদিত হয়ে গিয়েছিল। তবে পরের দু’টি প্রক্রিয়ায় কোথাও স্থগিত হয়ে আছে। কথিত আছে, দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার আসিয়ান রাষ্ট্র জোটের সদস্যরা এ ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব পোষণ করা বাকি দুই আইন শেষ পর্যন্ত আর করা হয়নি। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এটা মূলত গেরুয়া কাপড়ধারী ভিক্ষুদের পরিচালিত এক সংগঠনের দাবি। দেশব্যাপী ইসলামবিদ্বেষী উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিল। তা কখনো ওই চার আইনের পক্ষে প্রচার অথবা আইনগুলো পাস করার সাফল্যের প্রচার ইত্যাদি নামের আড়ালে। যেমন ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির মোট ১১৫১ জন প্রার্থীর দল এনএলডিসহ কোনো দলই একজন মুসলমান নমিনেশন দেয়নি। কারণ মুসলমানবিরোধী প্রচারণাকে ‘মা বা থা’ এত উগ্র ও তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল যে, ভোটে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এই ভয়ে সু চি রাখাইন অঞ্চলেও কোনো মুসলমানকে নমিনেশন দেননি।
মা বা থার চরম উগ্র এক নেতা হলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ইউ ভিরাথু। আমেরিকান টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়েই ২০১৩ সালের জুলাইয়ে কভার স্টোরি করেছিল। শিরোনাম দিয়েছিল, ‘বুদ্ধিষ্ট সন্ত্রাসবাদের মুখচ্ছবি’। এই ভিক্ষু খোলাখুলিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তিনি মনে করেন, ‘মুসলমানেরা দেশের জন্য, দেশের কালচারের জন্য হুমকি। তারা বেশি বাচ্চা পয়দা করে। তারা আমাদের নারীদের ধর্ষণ করে। তারা আমাদের দেশ দখল করতে চায়। তাই আমাদের বৌদ্ধদের বার্মা রক্ষা করতে হবে’ ইত্যাদি।
২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই ভিরাথু ও তাদের নানা সংগঠন (মা বা থা, ৩৬৫ এ ধরনের নামে) সু চির দলের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছে। গত নির্বাচনে ‘ছয় প্রশ্ন’ তারা হাজির করেছিল। যেমন, ১. আপনি কি বৌদ্ধ? ২. আপনি ‘চার আইন’ সাপোর্ট করেন কি না? ৩. এই আইনগুলো রক্ষা করবেন কি না? ৪. আপনি ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন বদলে ফেলবেন নাকি? ৫. কনস্টিটিউশনের ৫৯ এফ বদলাবেন নাকি, যে আইনে বিদেশী বিয়ে করেছে বলে সু চির প্রেসিডেন্ট হতে বাধা দেয়া আছে? ৬. ‘রেস ও রিলিজিয়ন’ আন্দোলন সব সময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে প্রতিজ্ঞা করবেন কি না।
সু চির ক্ষমতারোহণ ঘটে গেছে। আর ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা দেশ থেকে খেদানো আর হাজার পাঁচেক রোহিঙ্গা মেরে ফেলার পর সু চির সরকারের অবস্থান আর ভিরাথুর অবস্থানের মধ্যে আর কোনো ফারাক নেই। অবশ্য বিবিসির মিশেল হুসেন ২০১৬ সালের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় থেকে আমরা জানি, ব্যক্তিগতভাবেও সু চি মুসলমানবিদ্বেষে ভুগছে।