পাহাড়ে থেমে নেই খুন-অপহরণ ও ধর্ষণ। আর সেই খুন-অপহরণ ও ধর্ষণকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করছে কিছু মহল। আইন যাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনা। যতটুকুই পৌঁছে তাতে বেরিয়ে আসে কারা তারা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি চায় তারা। আর কারা করছে এসব ইস্যু সৃষ্টির খুন-গুম-ধর্ষণ।
কিছু ঘটনার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের উপর যেকোনো ধরনের অপরাধ হলেই তার দায়ভার বাঙালিদের উপর চাপিয়ে একটি গোষ্ঠী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে উঠে পড়ে লাগে। তাদের মূল লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে উপজাতি-বাঙালি সম্প্রীতি ধ্বংস করা এবং বাঙালিদের দায়ী করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলন গড়ে তোলা।
জাতিগত বিভেদ ভুলে সাধারণ বাঙালি এবং উপজাতিদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকলেও কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের এরুপ নানা নোংরা রাজনীতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের বিতাড়ণ করার বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা। এমনকি নিজেরাই কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত করে সেটাতে নানা রং চড়িয়ে বাঙালিদের সরাসরি দোষারোপ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি তারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করে মিডিয়া এবং জনগণের নজর কাড়ার চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষত: ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজ বা আইডি ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদেরকে উৎখাত করার লক্ষ্যে নানান মিথ্যাচার, গুজব এবং বিভ্রান্তিকর পোস্ট প্রদান করে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকটি ঘটনা ও পুলিশের রহস্য উন্মোচনের চিত্র তুলে ধরছি।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে খাগড়ছড়ি জেলা সদরে আপন ভগ্নিপতির ভাড়া বাসায় বোন ও ভগ্নিপতির অনুপস্থিতিতে গলা কেটে হত্যা করা হয় খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইতি চাকমাকে। এ হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সরাসরি বাঙালিদের দায়ী করে নানা রং ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে নানা অপপ্রচার চালায়। এমনকি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের ফেসবুকের চাকমা পেইজগুলোতেও আলোচনায় স্থান পায় ইতি চাকমা। তারা সকলেই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি বাঙালিদের দায়ী করে পোস্ট প্রকাশ করে। তারা ইতি চাকমার হত্যাকাণ্ডের পর হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে মিছিল, সমাবেশ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন, কালো ব্যাজ ধারণসহ নানান কর্মসূচি পালন করে।
কিন্তু দীর্ঘদির তদন্ত শেষে সকল রহস্যের পর্দা উন্মোচন করে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকায় রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ির বাসিন্দা সুনীল চাকমার ছেলে তুষার চাকমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তুষার চাকমা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছেন। ৫ জন চাকমা যুবক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কারণ ইতি চাকমা তুষার চাকমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারেক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, হত্যাকাণ্ডেরে রহস্য উদঘাটন সহযোগিতা করে চট্টগ্রাম সিআইডি ও খাগড়াছড়ির ডিবি। (সূত্র: কালের কন্ঠ ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ও পরিবর্তন ডটকম ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।
ইতি চাকমার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার দৃশ্যপটে বালাতি ত্রিপুরা নামের এক উপজাতি নারী। গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে খুন হয় বালাতি ত্রিপুরা। এবারও আটঘাট বেঁধে ওই মহলটি শুরু করে হৈ হৈ কাণ্ড। এবার তারা সমস্ত পার্বত্য বাঙালিকে ঢালাও ভাবে দোষারোপ না করে কৌশলে সুনির্দিষ্ট ভাবে করিম, নুরু আর মানিক নামে তিন বাঙালিকে দোষারোপ করে।
কিন্তু বিধি বাম। এবারও তাদের কূটকৌশল ধরা পড়ে যায়। ঘটনার মাত্র ছয়দিনের মাথায় বালাতি ত্রিপুরার খুনের মূল নায়ক কার্বারী সাধন ত্রিপুরা নামক এক উপজাতিকে গ্রেফতার করে পনছড়ি থানা পুলিশ।
পানছড়ি থানার ওসি মিজানুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বালাতি ত্রিপুরাকে সাধন কার্বারি ও তার আরো কয়েকজন সহযোগী মিলে কুপিয়ে হত্যা করেছে। হত্যা করার পর ইউপি সদস্য শিবুকে দিয়ে থানায় খবরও পাঠায় সাধন। বালাতিকে বাঙালিরা হত্যা করেছে এমনটি দাবিও করেছিল সাধান কার্বারি। এ হত্যার বিচার দাবি করে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে। (সূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭)।
গত ২৯ মে ২০১৬ ইং তারিখে মা মোবাইল সেন্টার নামক এক বাঙালি ছেলের দোকানে কলেজে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে যায় আয়না চাকমা নামে এক কিশোরী। বাঙালির দোকানে যাওয়ার অপরাধে ওই চাকমা কিশোরীকে সেখান থেকে ধরে এনে প্রকাশ্যে মারধর করে পাহাড়ি ছাত্রপরিষদ নামের একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পরে ওই কিশোরীকে গহীন জঙ্গলে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে এবং তা মোবাইলে ধারণ করেন তারা। আজো নিরাপত্তার অভাবে রয়েছে ওই কিশোরীর পরিবার। এই ঘটনায় অবশ্য পুলিশ কয়েকজন পাহাড়ি ছাত্রপরিষদ নেতাকে গ্রেফতার করেছে। তারা নেতার মুক্তির দাবিতে হরতাল-অবরোধ ও বিক্ষোভ করে। (সূত্র: পরিবর্তন ডটকম, ২৭ জুন ২০১৬)।
১৩ আগস্ট ২০১৪ তারিখে, রাঙ্গামাটি জেলা সদরে টেক্সটাইল শো রুমের বিক্রয়কর্মী বিশাখা চাকমা কর্মস্থল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় এবং ২০ আগস্ট রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে তার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পরপরই শুরু হয় বাঙালিদের দোষারোপের রাজনীতি। শুরু হয় সমাবেশ-মানববন্ধন।
কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় যে, বিশাখার স্বামী লক্ষীরাম চাকমার উপস্থিতিতে বখাটে সঞ্জয় চাকমা, তার সহযোগী তত্তারাম ও বিনোদ চাকমা মিলে বিশাখা চাকমাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। রাঙামাটি কতোয়ালি থানার ওসি মনু ইমতিয়াজ সোহেল তখন এ তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন। (সূত্র: সিএইচটি টাইমস, ২২ নভেম্বর ২০১৪।)
গত ৬ জুন ২০১৪ তারিখে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ব্র্যাক এনজিওর আনন্দ স্কুলের শিক্ষিকা উ প্রু মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তুলে স্থানীয় উপজাতীয় সংগঠনের সদস্যরা বাঙালি কাঠুরিয়া মুসলিম উদ্দিনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় ওই ধর্ষণ ও হত্যার মূল খলনায়ক উপজাতি রশদ তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা। (সূত্র: পার্বত্য নিউজ, ৮ জুন ২০১৪)।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে সবিতা চাকমার লাশ তার নিজ বাড়ির পাশের ক্ষেতে পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন পাহাড়ি সংগঠনগুলো সবিতা চাকমাকে বাঙালি ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপার গণধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগ তুলে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রতিবাদ মিছিল বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
পরবর্তীতে সবিতা চাকমার লাশের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন সবিতা চাকমার পিরিয়ড চলছিল এবং পিরিয়ডের অতিরিক্ত পোশাকগুলো ঠিকঠাক ছিল।
উপসংহারে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব বাঙালি এবং উপজাতি এদেশেরই গর্বিত নাগরিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সকলের অবদান অপরিসীম। তাই উপজাতি-বাঙালি ভেদাভেদ আর অতীতের হানাহানি ও বিবাদ ভুলে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
কুচক্রি মহলটির সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে, হতে হবে সচেতন। তবেই পার্বত্য এলাকায় শান্তির পরিবেশ আরও সুসংহত হবে এবং সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য অঞ্চলে মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসীদের সৃষ্ট অশান্তি সমূলে উৎপাটন করে সবাই মিলে শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতে পারলেই উন্নয়ন এবং উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিত হতে বাধ্য।