আদিবাসী বিষয়ে সরকারী নিষেধাজ্ঞা মানছে না সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো

আদিবাসী বিষয়ে সরকারী নিষেধাজ্ঞা মানছে না সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো





সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা সত্ত্বেও ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, জাতীয় ঐতিহাসিক স্থানে অনুষ্ঠান, কর্মসূচি পালন করছে সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। সরকার এসব স্থান ব্যবহারে অনুমতি প্রদানে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নির্দেশ দিলেও উদাসীন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
উপজাতীয়দের আদিবাসী উল্লেখ না করার বিষয়ে ইতোপূর্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে নির্দেশনা প্রদান করা সত্ত্বেও তার কোন কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন করতে একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ৯ আগস্ট বিশ^ আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত এ ঐতিহাসিক স্থানসহ জাতীয় স্থাপনাসমূহে বিচ্ছিন্নতাবাদি দাবির পক্ষে ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৩ অধিশাখা থেকে ‘‘বাংলাদেশে আদিবাসী নামক অসাংবিধানিক দাবি বাস্তবায়নের অপকৌশল রোধে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন” সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এ নির্দেশনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশী-বিদেশীদের সহায়তায় বাংলাদেশে আদিবাসী নামক অসাংবিধানিক দাবিটি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অপকৌশল ও ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক শহর কেন্দ্রীক বিশেষ করে ঢাকা মহানগরের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা/অবকাঠামো যেমন: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় শহীদ মিনার, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, টিএসসি চত্বরসহ আরো অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মসূচী পালনের জন্য ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাগণকে সম্পৃক্ত করার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়।
উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও আদিবাসী শব্দের ব্যবহার করা হয় না। উপরোক্ত প্রতিবেদন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান অনুযায়ী আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা জারি করেছে মন্ত্রণালয়টি। এ ছাড়াও ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীদের উপজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আদিবাসী সার্কুলার
সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাস মতে, মাত্র কয়েকশ বছর আগে বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সকলেই বিতাড়িত হয়ে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। এদের বেশিরভাগ মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা উপজাতিদের আদি নিবাস চম্পকনগর ছিল যে বিষয়ে তাদের নিজেদেরও দ্বিমত নেই। ইতিহাস পূর্বকাল থেকে এ ভূখণ্ডে কেবল বাঙালি জাতির বসবাস রয়েছে। অতএব বাঙালিরাই একমাত্র আদিবাসী।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুগ যুগ ধরে নিজেদের উপজাতি হিসেবে আত্মস্বীকিৃত দিয়ে আসছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। কিন্তু গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে জাতিসংঘ ৬১তম অধিবেশনে ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ জারি করার পর হঠাৎ করে তারা নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করতে শুরু করেন। জাতিসংঘও তাদের আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এরকম হঠাৎ করে আদিবাসী হতে চাওয়ার নজির বিশ্বে আর কোথাও নেই।
এদিকে আদিবাসী-উপজাতি বিতর্ক প্রসঙ্গে জাতিসংঘে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (জাতিসংঘ অনুবিভাগ) ২৫ জুলাই ২০০৫ সালে এক পরিপত্রে জানায়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী তারাই যারা যুগ যুগ থেকে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বাস করে আসছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবর্জিন। এ বিবেচনায় জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত না করে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি চিহ্নিত করে আসছে।
এতে আরও বলা হয় জাতিসংঘ ফোরামে ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশহগুলোও তাদের উপজাতি জনগোষ্ঠীদের কখনও আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে না। এ দুটি শব্দকে সমর্থক হিসেবে ব্যবহৃত করা জাতিংসঘে আদিবাসী সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থানের পরপিন্থী। এর প্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগের একই অবস্থান গ্রহণের নির্দেশনা দেয়।
পার্বত্য উপজাতিয় সম্প্রদায়গুলোকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতা বিষয়ে গোপনীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সংবাদ মাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে উপজাতি না বলে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে। ইউএনডিপি, ডানিডা, এডিবিসহ উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠানর জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরমাধ্যমে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সরকারি অবস্থানের ও সংবিধানের বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা ইতিমধ্যে আদিবাসী ফোরম নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতীয়দের নিয়ে প্রতি বছর ঢাকায় সমাবেশে করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ অনুসারে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বতন্ত্র তথা স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি তারা মনে করে যে তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকবে না বা ভারতেও যোগ দেবে না; তবে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকলেও তারা যে অঞ্চলে বাস করে সেই অঞ্চলের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশের হবে না এবং সে অঞ্চলে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। আর এক্ষেত্রে আদিবাসীদের সহায়তার নামে যে কোন সময় হস্তক্ষেপ করতে পারবে জাতিসংঘ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বলেন, যারা আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করে অনুষ্ঠানের অনুমতি দিচ্ছেন তারা দ্বিমুখী আচরণ করছেন এবং পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না। আমি কোনো মতেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে নই। সাংবিধানিকভাবে তাদের অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু আদিবাসী শব্দটি বা আদিবাসী পরিচয়টি যদি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। এই পরিচয় আদায়ের মাধ্যমে উপজাতিরা এমন কিছু অধিকার পাবে যা বাংলাদেশ সংবিধানের পরিপন্থী।
তিনি আরো বলেন, উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে স্কীকৃতি দিলে তাদের অনুমতি ছাড়া পার্বত্য-চট্টগ্রাম থেকে তেল-গ্যাস আনা যাবে না। সেনাবাহিনী, আনসার ক্যাম্প ও সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা যাবে না।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী শব্দটি উল্লেখ না করার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। সেই বিজ্ঞপ্তি আমরা মেনে নেয়নি। এমনকি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। ঐ বছরে এটি নিয়ে সমস্যা হয়। তবে পরবর্তীতে এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করা হয়নি। ২০১৫ সালে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করে সমাবেশ করেছি কোনো সমস্যা হয়নি, এবারও সমস্যা হবে না।
তিনি বলেন, ৯ আগস্ট শাহবাগ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করে সমাবেশ করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অনুমতি দিয়েছে। আগামীকাল ডিএমপিকে চিঠি পাঠিয়ে অবহিত করা হবে। সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন রাশেদ খান মেনন। সরকারের ভেতরে একটা গ্রুপ রয়েছে যারা আদিবাসী ধারণার বিপক্ষে।
সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী শব্দ রয়েছে আদিবাসী শব্দ নেই। এজন্য আমরা আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করতে পারবো না, এটা কোন নীতি বলে প্রশ্ন রাখেন সঞ্জীব দ্রং।