ক্ষূদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ বাংলাদেশের আদিবাসী নয়। আদিবাসী ও উপজাতি বিতর্কের কারণ কি?

Related imageক্ষূদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ বাংলাদেশের আদিবাসী নয়।
আদিবাসী ও উপজাতি বিতর্কের কারণ কি?

উপজাতি এবং আদিবাসী। আদিবাসী বলতে ইংরেজিতে Aboriginals বা indigenous people-ও বলে। উপজাতি হলো Tribe এটা উপনিবেশিক শব্দ। আমাদের দেশে বাঙালি মূলধারার বাইরে যারা আছে তারা আদিবাসী নয়। তাদের আমরা উপজাতি বলতেও নারাজ। বরং তাদেরকে বলা যেতে পারে ethnic বা নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী । নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় আদিবাসী বা ‘এবোরিজিন্যালস’রা হচ্ছে ‘কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা Son of the soil।’ প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’ মর্গান বলেন, The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial … they are the true Sons of the soil…’ (Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972).

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খর্বাকৃতির স্ফীত চ্যাপ্টা নাক কুঁকড়ানো কেশবিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণের ‘বুমেরাংম্যান’রা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বা যথার্থ এবোরিজিন্যালস। তারা ওখানকার ভূমিপুত্রও বটে। ঠিক একইভাবে মাউরি নামের সংখ্যালঘু পশ্চাৎপদ প্রকৃতিপূজারী নিউজিল্যান্ডের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সেখানকার আদিবাসী। আমেরিকার বিভিন্ন নামের মঙ্গোলীয় ধারার প্রাচীন জনগোষ্ঠী যাদেরকে ভুলক্রমে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ (উত্তর আমেরিকা) বলা হয় এবং সেন্ট্রাল আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকা, আজটেক, মায়ান, আমাজানসহ আরো অসংখ্য ক্ষুদ্র বিল্প্তু কিংবা সঙ্কটাপন্ন (Extinct or Endangered Groups) জনগোষ্ঠীকে সঠিক ‘এবোরিজিন্যালস’ বলে চিহ্নিত করা যায়।

তথাকথিত সভ্য সাদা, ইউরোপীয় নতুন বসতি স্থাপনকারী অভিবাসীরা (A New Settlers and Immigrants) ঐসব মহাদেশের আদিবাসীদের নির্মম বিদ্বেষ, হিংস্র প্রবঞ্চনা, লোভ আর স্বার্থপর আগ্রাসনের দ্বারা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকোসহ সেন্ট্রাল ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশ, স্প্যানিশ, ফরাসি, পর্তুগীজ প্রভৃতি উপনিবেশবাদী শক্তি বিগত ৩/৪টি শতক ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে জাতিগত নির্মূল তৎপরতার মাধ্যমে (Ethnic Cleansing) এসব মুক্ত স্বাধীন আমেরিকান আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোকে পৃথিবী থেকে প্রায় নির্মূল করে দিয়েছে। আজ ঐ শ্বেতাঙ্গ মার্কিন, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় এবং ইউরোপীয় তথাকথিত সুশিক্ষিত, ধ্বজাধারী সাবেক উপনিবেশবাদীদের নব্য প্রতিনিধিরা তাদের নব্য উপনিবেশবাদী অর্থাৎ তথাকথিত মুক্ত অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রসমূহের জন্য ‘আদিবাসী সংরক্ষণ’ (Conservation of Aboriginal)-এর ধুয়া তুলে তাদের অর্থের মদদপুষ্ট এনজিও এবং মিশনারী চক্রের সুনিপুণ প্রচারণায় ও ষড়যন্ত্রে উপজাতিগুলোর জন্য মায়াকান্না শুরু করেছে। আরম্ভ করেছে ভয়ানক সূক্ষ্ম সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্র আর আধিপত্যবাদী চাণক্য চাল।

এসব উপজাতি, আদিবাসী কিংবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর এই মায়াকান্নার পেছনে মূলত ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক, ভূ-অর্থনীতিক এবং সর্বোপরি আধিপত্যবাদী স্বার্থই প্রবলভাবে কাজ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃত আদিবাসীদের তারা যেখানে গণহত্যা, জাতিগত নির্মূলসাধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানে তারা এখন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন সম্ভাবনাময় স্বাধীনচেতা উঠতি শক্তি বিশেষ করে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে এসব উপজাতি (Tribal) ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পক্ষে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন, জাতিসত্তার বিকাশ, আদিবাসী সংরক্ষণ’ ইত্যাদির কথা বলে ভাষাগত, বর্ণগত, ধর্মগত, সাংস্কৃতিক বিভাজন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রেক্ষাপট তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

সাম্রাজ্যবাদীদের ঐ হীন চক্রান্তের ফলশ্রুতিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ইত্যাদি এককালীন ঔপনিবেশিক শক্তিদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও আজ্ঞাবহ জাতিসংঘের (ইউএনও) সহযোগিতায় বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার যৌক্তিক সার্বভৌম অঞ্চল তিমুর দ্বীপের পূর্বাঞ্চলকে (ইস্ট-তিমুর) বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ইস্ট-তিমুরের এই বিচ্ছিন্নতার পেছনে আসলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র কাজ করেছে এবং এখানেও আদিবাসী, উপজাতি ইত্যাদি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে সর্বনাশা খ্রিস্টবাদী এনজিও চক্র, মিশনারি গ্রুপ এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংরক্ষণ (Human Rights Activists) চক্র। এশিয়ার উদীয়মান ব্যাঘ্র (Emerging Tiger of Asia) ২০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার তিমুর দ্বীপের কাছের দক্ষিণেই হালকা জনসংখ্যা অধ্যুষিত শ্বেতাঙ্গ ও খ্রিস্টান অধ্যুষিত অস্ট্রেলিয়াসহ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং অস্ট্রেলিয়া এই কৌশলগত ও অবস্থানগত দুর্বলতাকে চিরতরে দূর করাতেই খ্রিস্টবাদী পরাশক্তিসমূহ জাতিসংঘকে ব্যবহার করে অত্যন্ত সুকৌশলে ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকে স্বাধীন করে দেয়।

আর ঐ একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশেও একই খ্রিস্টবাদী সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ তাদের আধিপত্যবাদী ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থকে (Geo-Political and Strategical Interests) সংরক্ষণ ও চরিতার্থ করার জন্য তাদের সেই কৌশলকে বাস্তবায়িত করতে চাচ্ছে। এ জন্য তারা বেছে নিয়েছে দেশের এক-দশমাংশ অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, মগসহ বিভিন্ন বসতি স্থাপনকারী উপজাতীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে। একই সাথে এই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তাদের অর্থপুষ্ট এনজিও চক্র বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন : সিলেটের খাসিয়া, মণিপুরী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের গারো, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরের বনাঞ্চলের কুচ রাজবংশীয় বহিরাগত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এদেশের আদিবাসী বলে প্রচার-প্রপাগাণ্ডা চালাতে শুরু করেছে এবং এর মাধ্যমে এদের এসব সংশ্লিষ্ট বৃহদায়তনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ভূমিপুত্র (Son of the Soil) বলে প্রতিষ্ঠিত করার এক হীন চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

যদিও নৃতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস বিশ্লেষণে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত যে বাংলাদেশে বসবাসরত কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী নয়। বরং তারা পার্শ্ববর্তী কিংবা বিভিন্ন দূরবর্তী স্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশের নানা স্থানে অভিবাসিত হয়ে ক্রমে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করে আসছে।
কিন্তু কোনোক্রমেই বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, খাসিয়া কিংবা কুচ রাজবংশীয় সাঁওতালরা এদেশের আদিবাসী হতে পারে না।

তাহলে বাংলাদেশে আদিবাসী কারা?

বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষীরা। কারণ তারাই প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড (proto Astroloid) নামের আদি জনধারার অংশ বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তারাই একমাত্র আদিবাসী এবং Son of the Soil বলে দাবি করতে পারে। এর পেছনে অনেক জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণও রয়েছে।
প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড ধারার বাঙালি নামের বাংলাদেশের এই আদিবাসীরা যদিও একটি মিশ্র বা শংকর জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত সেখানে ককেশীয়, মঙ্গোলীয়, অস্ট্রিক জাতিধারার সাথে ভেড্ডাইট, নিগ্রোয়েড, দ্রাবিড়ীয় এবং অন্যান্য বহু জানা-অজানা আদি জনধারার সংমিশ্রণ ও নৃতাত্ত্বিক মিথষ্ক্রিয়া সাধিত হয়েছে। তবুও যেহেতু এসব জনগোষ্ঠীর এদেশে সুস্পষ্ট অস্তিত্বের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে অনুদঘাটিত ও অজানা এবং স্মরণাতীতকালের হাজার হাজার বছর আগে থেকে এদের পূর্বপুরুষরা এই নদীবিধৌত পলল সমভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করেছে সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই একমাত্র তাদেরকে অর্থাৎ বাঙালিরাই Son of the Soil বা আদিবাসী বলা যায়। বিশ্বের তাবৎ শীর্ষস্থানীয় নৃবিজ্ঞানী এবং গবেষকবৃন্দই এ ব্যাপারে একমত।

এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো যে আদিবাসী নয় এর প্রমাণ কি?

বাংলাদেশের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয় তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ RHS Huchinson (1906) T H Lewin (1869), অমেরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬), J. Jaffa (1989) এবং N Ahmed (1959) প্রমুখের লেখা, গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। তারা সবাই একবাক্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতীয়দের নিকট অতীতের কয়েক দশক থেকে নিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এদেশে স্থানান্তরিত হয়ে অভিবাসিত হবার যুক্তি-প্রমাণ ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

খোদ চাকমা পণ্ডিত অমেরেন্দ্র লাল খিসা ‘অরিজিনস অব চাকমা পিপলস অব হিলট্রেক্ট চিটাগং’এ লিখেছেন, ‘তারা এসেছেন মংখেমারের আখড়া থেকে পরবর্তীতে আরাকান এলাকায় এবং মগ কর্তৃক তাড়িত হয়ে বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করেন। আজ থেকে আড়াইশ তিনশ; বছর পূর্বে তারা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর দিকে রাঙামাটি এলাকায়।’ এর প্রমাণ ১৯৬৬ বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি প্রকাশিত দি অরিয়েন্টাল জিওগ্রাফার জার্নাল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই বাঙালি এবং বাকি অর্ধেক বিভিন্ন মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত উপজাতীয় শ্রেণীভুক্ত। একথা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে উপজাতি জনগোষ্ঠীর বাইরের ভূমিপুত্র বাঙালিরা বসবাস করে আসছে। তবে জনবসতি কম হওয়ায় বিভিন্ন ঘটনার বা পরিস্থিতির কারণে আশপাশের দেশ থেকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জাতি বহির্ভূত অন্য সকল উপজাতীয় গোষ্ঠীই এখানে তুলনামূলকভাবে নতুন বসতি স্থাপনকারী। এখানকার আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ম্রো, খ্যাং, পাংখো এবং কুকিরা মূল ‘কুকি’ উপজাতির ধারাভুক্ত। ধারণা করা হয়, এরা প্রায় ২শ’ থেকে ৫শ’ বছর আগে এখানে স্থানান্তরিত হয়ে আগমন করে। চাকমারা আজ থেকে মাত্র দেড়শ’ থেকে ৩শ’ বছর পূর্বে মোগল শাসনামলের শেষ থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে মায়ানমার আরকান অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে (Lewin 1869)।

প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ প্রশাসক টি. এইচ. লেউইন-এর মতে,

“A greater portion of the hill tribes at present living in the Chittagong Hill Tracts undoubtedly come about two generations ago from Aracan. This is asserted both by their own traditions and by records in Chittagong Collectorate”. (Lewin, 1869, p. 28)।
পার্বত্য অঞ্চলের মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সনে এ অঞ্চলে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং আধিপত্য বিস্তার করে (Shelley, 1992 and Lewin, 1869)। এরা ধর্মে বৌদ্ধ মতাবলম্বী। এরা তিনটি ধারায় বিভক্ত। যেমন : জুমিয়া, রোয়াং ও রাজবংশী মারমা।

ব্যোমরা মায়ানমার-চীন পর্বত থেকে নিয়ে তাশন পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করে। খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতার ফলে এদের অধিকাংশই বর্তমানে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। লুসাইরাও এখন অধিকাংশই খ্রিস্টান। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য একটি বড় জনগোষ্ঠী মুরং। এদের বেশির ভাগই এখন পর্যন্ত প্রকৃতি পূজারী এবং এদের কোনো ধর্মগ্রন্থও নেই (Bernot, 1960) চাকমারা এখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও ভাষার দিক দিয়ে তারা ত্রিপুরা, মারমা বা অন্য যে কোনো পার্বত্য জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের ভাষা এখন অনেকটা বাংলা ভাষার কাছাকাছি। মারমা (মগ)গণ আরাকানী বর্মীয় উপভাষায় কথা বলে এবং ত্রিপুরাগণ ত্রিপুরি তিব্বতিধর্মী উপভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের ধর্মপ্রচারের জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত-সংলগ্ন মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরার বেশিরভাগ উপজাতীয় জনগোষ্ঠী খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে ঐ অঞ্চলে ঐসব বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টধর্মের ছত্রছায়ায় একত্রিত করে বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশে ভারত-বাংলাদেশের এই পার্বত্য ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পূর্বাংশের যুক্তরাষ্ট্রে ও পাশ্চাত্য শক্তি ইসরাইলের মতো একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনায়ই নয়, বরং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখেও দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐসব মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল এবং বিস্তর অনৈক্য বর্তমান। এদের এক একটি জনগোষ্ঠীর বিবাহরীতি, আত্মীয়তা সম্পর্কে (Keen-ship Relations), সম্পত্তির মালিকানা বণ্টনরীতি এবং উত্তরাধিকার প্রথা, জন্ম ও মৃত্যুর সামাজিক ও ধর্মীয় কৃত্যাদি বা অন্যান্য সামাজিক প্রথা এবং রীতি এক এক ধরনের এবং প্রায় প্রত্যেকটি আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত (Denise and Bernot, 1957)।

পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এসব জনগোষ্ঠীগুলোর প্রায় সবাই যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং হিংস্র দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে তাদের পুরাতন বসতি স্থান থেকে এখানে পালিয়ে এসেছ। নতুবা, এক জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর পশ্চাদ্ধাবন করে আক্রমণকারী হিসেব এদেশে প্রবেশ করেছে (Hutchinson, 1909, Bernot, 1960 and Risley, 1991)। বর্তমানেও এদের পরস্পরের মধ্যে প্রচুর রেষারেষি এবং দ্বন্দ্ব বিদ্যমান রয়েছে বলে জানা যায় (Belal, 1992)।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জনসংখ্যার বণ্টনচিত্রও সমান নয়। এরা গোষ্ঠী ও জাতিতে বিভক্ত হয়ে সারা পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করে। তবে কোনো কোনো স্থানে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মিশ্র জনসংখ্যা দৃষ্টিগোচর হয়। চাকমারা প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের চাকমা সার্কেলে কর্ণফুলী অববাহিকা এবং রাঙামাটি অঞ্চলে বাস করে। মগরা (মারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামে দণিাংশের বোমাং এবং মং সার্কেলে বাস করে। ত্রিপুরা (টিপরা)গণ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সার্কেলে অর্থাৎ চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল সকল স্থানেই ছড়িয়ে থাকলেও নিজেরা দল বেঁধে থাকে। ম্রো, খ্যাং, খুমী এবং মুরং বোমাং সার্কেলের বাসিন্দা।

বাংলাভাষী বাঙালি অভিবাসীরা সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও এদের বেশিরভাগই দলবদ্ধভাবে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রামগড় প্রভৃতি শহরাঞ্চলে বসবাস করে। বাকি বাঙালি জনসংখ্যা এখানকার উর্বর উপত্যকাগুলোর সমভূমিতে গুচ্ছগ্রামে বসাবস করে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের বাদ দিলে এখন আসে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট-মৌলভীবাজারের খাসিয়া, মণিপুরী, পাত্র (পাত্তর) গোষ্ঠীর কথা। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল অঞ্চলের গারোদের কথা এবং দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর-দিনাজপুরের কুচ রাজবংশী সাঁওতাল, ওরাও ও মুণ্ডাদের কথা। এদের সবাই সংখ্যার দিক বিচারে খুব নগণ্য ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে প্রামণিত যে, সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, মণিপুরী ও পাত্ররা তৎকালীন বৃহত্তর আসামের খাসিয়া জয়ন্তী পাহাড়, মণিপুর, কাঁচাড় ও অন্যান্য সংলগ্ন দুর্গম বনাচ্ছাদিত আরণ্যক জনপদ থেকে যুদ্ধ, আগ্রাসন, মহামারী এবং জীবিকার অন্বেষণশোন সুরমা অববাহিকায় প্রবেশ করে ও সিলেটের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে বসতি স্থাপন করে। নৃ-বিজ্ঞান ও ভৌগোলিক জ্ঞানের সকল বিশ্লেষণেই এরা উপজাতীয় এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বৈ আর কিছুই নয়। এরা কোনো বিবেচনায়ই সিলেটের আদিবাসী হতে পারে না। এরা আদি আরণ্যক পার্বত্য নিবাসের (আসাম, মণিপুর, মেঘালয় ইত্যাদি) আদিবাসী হলেও যখন স্থানান্তরিত হয়ে নতুন ভূখণ্ডে আসে সেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠী কিংবা ভিন্ন সংস্কৃতির ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে সমান্তরালভাবে থাকতে পারে। কিন্তু কখনো তারা নতুন জায়গায় আদিবাসী হতে পারে না।

ঠিক একইভাবে, ময়মনসিংহ (হালুয়াঘাট অঞ্চল) এবং টাঙ্গাইল অঞ্চলের (মধুপুর) গারো সিংট্যানেরা ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের পরে এদের অনেকে তাদের আদিনিবাস ভারতের উত্তরের গারো পাহাড়ে ফিরে গেলেও বেশ কিছুসংখ্যক গারো ও সিংট্যানরা বাংলাদেশের ঐসব অঞ্চলে রয়ে গেছে। গারোদের আদি নিবাস ভারতের গারোল্যান্ড। কোনোক্রমেই ময়মনসিংহ কিংবা টাঙ্গাইলের আদিবাসী হতে পারে না। আরো বলা যায়, মাত্র ব্রিটিশ শাসনামলে আজ থেকে ৬০-৭০ কিংবা একশ’, সোয়াশ’ বছর আগে সিলেটের শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং উত্তর সিলেটের কোনো কোনো নিচু পাহাড়ি অঞ্চলে চা বাগান স্থাপনের জন্য ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা বর্তমান ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন জঙ্গলাকীর্ণ মালভূমি অঞ্চল যেমন ছোট নাগপুরের বীরভূম, সীঙভূম, মানভূম, বাকুড়া, দুমকা, বর্ধমান প্রভৃতি অঞ্চল যা তৎকালীন সাঁওতাল পরগণাখ্যাত ছিল সেসব অঞ্চলে গরিব অরণ্যচারী আদিবাসী সাঁওতাল, মুণ্ডা, কুল, বীর, অঁরাও, বাউরী ইত্যাদি নানা নামের কৃষ্ণকায় আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষকে শ্রমিক হিসেব স্থানান্তরিত করে অভিবাসী হিসেবে নিয়ে আসে।

একইভাবে যুদ্ধ, মহামারী থেকে আত্মরক্ষার জন্য এবং জীবিকার সন্ধানে রাজমহলের গিরিপথ ডিঙ্গিয়ে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলে (রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর) বাসবাস শুরু করে। উত্তরাঞ্চলের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলা থেকে দক্ষিণের রংপুর-দিনাজপুরের নদী অববাহিকামণ্ডিত সমভূমিতে নেমে বসবাস শুরু করে কুচ ও রাজবংশী জনগোষ্ঠী। এরা সকলেই তাদের মূল নিবাসের আদিবাসী হিসেব বিবেচ্য হলেও কোনো যুক্তিতে তাদের নতুন আবাসস্থল বাংলাদেশের ঐসব অঞ্চলগুলোর আদিবাসী বা ভূমিপত্র হিসেব চিহ্নিত হতে পারে না।

উল্লেখ্য, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে ও স্থানীয় অন্যান্য বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাথে কুচ রাজবংশীদের অনেকে সমসংস্কৃতিকরণ প্রক্রিয়ার (Acculturation Process) মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে একীভূত (Assimilated) হয়ে গেছে। এটা দোষের কিছু না বরং ভালো। মানবিক বিবেচনার মহানুভবতায় এদেশে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর সমান মর্যাদা, অধিকার ও স্বীয় জাতি, ভাষা, ধর্ম তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের পূর্ণ অধিকার এবং সম্মান নিয়ে সবাই স্বকীয়তায় সমান্তরাল চলতে পারে বা মিশে যেতে পারে। কিন্তু কোন্ বিবেচনায় ক্ষূদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ বাংলাদেশের আদিবাসী নয়।