সাওতালরা আদিবাসী নয় ------------------
সাঁওতালদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এসব আলোচনা যথেষ্ট ইতিহাসভিত্তিক হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সাঁওতালদের বলা হচ্ছে, এ দেশের অন্যতম আদিবাসী (Aborigine)। কিন্তু সাঁতালরা এ দেশের ভূমিপুত্র নয়। তাদের বলতে হয় আগন্তুক উপজাতি (Tribe)। সাঁওতালদের লোককথায় বলে, তারা এসেছে, হিহিড়ি পিপিড়ি দ্বীপ থেকে। কিন্তু এই হিহিড়ি পিপিড়ি দ্বীপ ঠিক কোথায়, সেটা এখনো নির্ণয় করা যায়নি। সাঁওতালদের নৃতত্ত্বের বইয়ে সাধারণত স্থাপন করা হয় প্রোটো-অস্ট্রালয়েড মানবধারায়। প্রটো-অস্টোলয়েড নামটা দেন ড. বিরোজা শঙ্কর গুহ, ১৯৩১ সালের আদমশুমারির সময়। সে এ সময় ছিল কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান।সে নামটা চয়ন করেন সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, হো, কোল, ভিল প্রভৃতি উপজাতিকে বর্ণনা করার জন্য। প্রটো-অস্টোলয়েড কথাটির বাংলা আমরা করতে পারি প্রায়-অস্ট্রালয়েড। এদের এই নাম দেয়া হয়েছে, কেননা এদের চেহারার সৌসাদৃশ্য আছে অস্ট্রেলিয়ার আদিম কালো মানুষদের সঙ্গে। অবশ্য পার্থক্যও আছে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা প্রটো-অস্ট্রোলয়েড মানবধারার মানুষদের চেয়ে দৌহিক উচ্চতায় হয় বেশি এবং ভুরুর হাড় হয় অনেক উন্নত। এদের কপালের মধ্যভাগ প্রটো-অস্ট্রোলয়েডদের তুলনায় বেশ কিছুটা নিচু। প্রটো-অস্ট্রোলয়েডদের গায়ের রঙ অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের মতোই কালো। মাথার চুল মোটা ও ঘন। তবে মসৃণ। নাকের অগ্রভাগ মোটা ও শোশতবহুল। কিন্তু চ্যাপটা নয়। মাথার আকৃতি লম্বা। নৃতত্ত্বে মানবধারা বিভাগের সময় মাথার আকৃতির ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়। লম্বা মাথা বলতে বোঝায় এমন মাথা, যার প্রস্থকে দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করলে দাঁড়ায় ৭৫ বা তার কম। মাঝারি মাথা বলতে বোঝায়, যাদের প্রস্থ হলো দৈর্ঘ্যরে শতকরা ৭৫ ভাগ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে। আর গোল মাথা বলতে বোঝায় সেই সব মাথাকে, যাদের প্রস্থ দৈর্ঘ্যরে শতকরা ৮০ ভাগ অথবা তার বেশি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের মাথা মধ্যমাকৃতির অথবা গোল। সাঁওতালদের মতো লম্বাকৃতি নয়। তাই সাঁওতালদের মতো মানুষের থেকে বাংলাদেশের মানবসমষ্টির উদ্ভব হতে পেরেছে, এ রকম সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে না। যেমন আগে অনেকে করতে।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে বর্ধমান জেলার পাণ্ডু রাজার ঢিবি এবং বিরভুম জেলার মহিষাদল নামক জায়গায় উৎখনন চালানো হয়। এর ফলে তাম্র-প্রস্তর যুগের এক উন্নত সভ্যতার আবিষ্কার হতে পেরেছে। এখানে পাথরের অস্ত্রের সাথে তামার জিনিস পাওয়া গেছে। তামার তৈরি জিনিসের মধ্যে পাওয়া গেছে মাছ ধরার বড়শি। যার সাহায্যে এই জায়গার এই সময়ের মানুষ মাছ ধরে আহার সম্পন্ন করত। মহিষাদলে একটা পোড়ামাটির পাত্রের মধ্যে কিছু কয়লা হয়ে যাওয়া ধান পাওয়া গেছে। রেডিও অ্যাকটিভ কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে যার বয়স নির্ণিত হয়েছে ১৩৮০ থেকে ৮৫৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। যার থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, এই সময় মানুষ ধানচাষ করে তা থেকে চাল উৎপাদন করে আহার করত। অর্থাৎ এদের জীবন ছিল আমাদেরই মতো মাছ-ভাতনির্ভর। মানুষ এই সময় এখানে মৃতদেহ সমাধিস্থ করত। শবদেহ শায়িত করত পূর্ব-পশ্চিমে। এসব মানুষের মাথার খুলি হলো মধ্যমাকৃতির। সাঁওতালদের মতো লম্বাকৃতির নয়। এদের মাথার আকৃতির সাথে সাদৃশ্য আছে বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক জনসমষ্টির মাথার। তাই ধারণা করা যায়, আমরা অনেকে বহন করছি এসব মানুষের জীবনধারাকে। এসব কবরে পাওয়া গেছে বৈশিষ্ট্যময় মৃৎপাত্র। যার অনুরূপ মৃৎপাত্র এখনো কিছু কিছু পরিদৃষ্ট হয়। আমাদের পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে, সাঁওতালরা হলো এ দেশের আদিবাসী। আর আমরা হলাম পরদেশী। যেটা সত্য নয়।
ইংরেজি ভাষায় ট্রাইব শব্দটা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ট্রাইব কথাটার বাংলা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হয়েছিল উপজাতি। বাংলায় উপজাতি বলতে বোঝায় এমন জনসমষ্টি, যারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। যারা বাস করে সভ্যমানুষের কাছাকাছি। কিন্তু যাদের সভ্যতা পড়ে আছে প্রস্তরযুগের পর্যায়ে। যারা বাস করে দুর্গম পাহাড়ি ও আরণ্যক অঞ্চলে। যারা লাঙ্গল দিয়ে কৃষিকাজ করতে জানে না। যারা মাটিতে কাঠের খুঁটা দিয়ে গর্ত করে বীজ বপন করে চাষাবাদ করে। যাকে বলা হয় জুম অথবা ধাইয়া। এ ছাড়া এই চাষপদ্ধতির অন্য নামও আছে। তবে এসব মানুষ চাষাবাদের চেয়ে বন্য ফলমূল আহরণ ও পশু শিকার করে খেতেই বিশেষ অভ্যস্ত। এদের প্রত্যেকের একটি করে ভাষা আছে। কিন্তু ভাষাটা লিখিত নয়। সাঁওতালদের ধরা হয়েছে একটা উপজাতি। কেননা, এরা সবাই দেখতে একই রকম, একই ভাষায় কথা বলে এবং বাস করে একত্রে। এ ছাড়া এদের ধর্মবিশ্বাসও এক। অর্থাৎ উপজাতি বলতে এসেছে মানবধারা, ভাষা ও ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গ।
উপজাতি ও জাতির মধ্যে পার্থক্য হলো, জাতির জনসমষ্টি হলো অনেক বেশি। ভাষা এক। কিন্তু একটি জনসমষ্টির মধ্যে থাকা সম্ভব একাধিক মানবধারার মানুষ। যেমন আছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। জাতি আর উপজাতিকে এক করে দেখা যায় না। একটি উপজাতি এসে বসবাস আরম্ভ করতে পারে একটি জাতির মধ্যে। যেমন সাঁওতালরা করছে আমাদের মধ্যে। সাঁওতালরা বাস করছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। এদের নীলকর সাহেবরা নিয়ে আসে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে মালদহের পূর্বাঞ্চলে নীলচাষ করার জন্য। সেখান থেকে এরা ছড়িয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায়। বিখ্যাত ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক জর্জ গ্রিয়ার্সন লিখেছেন সাঁওতালদের মালদহের পূর্বাঞ্চলে নিয়ে আসবার কথা (G. A. Grierson: Linguistic Survey of India, Vol 4, 1906. Page 30-33pp)।