চাকমা
চাকমা প্রথা মতে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর শুধুমাত্র তার পুত্র বা পুত্র সন্তানরাই একমাত্র উত্তরাধিকারী হন। কন্যা সন্তান কোন প্রকার সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। কন্যা সন্তান পরিবারের অমতে বিয়ে করলে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। বিচারে সাধারণত ১ অথবা ২ মুষ্ঠিতে ধরা যায় এমন শুকর সমাজের সকলকে খাওয়ানোর আদেশ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপমানজনকভাবে সকলের সামনে তাদের জুতার মালা পরানো হয়। তারপর তাদের বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়। চাকমা নারীরা তাদের স্বামীর সম্পদেরও কোন অংশ পান না।
মারমা
মারমা সম্প্রদায়ের প্রচলিত প্রথা কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। মারমা সম্প্রদায়ের বার্মিজ প্রথা অনুসরণকারী উপজাতিগণ বিশেষ করে বান্দরবানে বসবাসরত মারমা সম্প্রদায়ের মেয়েরা পিতা-মাতার সম্পত্তি ছেলেদের ন্যায় সমানভাবে উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন। তবে যে সন্তান পিতা-মাতার ভরণ পোষণ বহন করবে তাকে একভাগ বেশি সম্পত্তি দেওয়া হয়ে থাকে। পরিবারের অমতে নারীগণ বিবাহ করলে সমাজ তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা না করা পর্যন্ত তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন।
তবে খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত মারমা সম্প্রদায়ের নারীগণ পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না। মারমা সমাজে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করলে ঐ ব্যক্তির সকল অস্থাবর সম্পত্তিসহ ঘরবাড়ী প্রথম স্ত্রীকে দিতে হয়। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্ত্রী কোন সম্পত্তি পান না, তবে তার (দ্বিতীয় স্ত্রীর) সন্তানেরা পিতার স্থাবর সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ পেয়ে থাকেন।
মারমা সমাজে আরও একটি অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত আছে, যা নারীদের জন্য চরমভাবে অপমানজনক। কোন মারমা ছেলে কোন মারমা মেয়েকে পছন্দ হবার পর যদি জোর করে ধরে নিয়ে আসে এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বিয়ে বাড়ীর মত আপ্যায়ন করে, তবে সমাজ বিষয়টি মেনে নেয়। এ ক্ষেত্রে উক্ত নারীর ব্যক্তিগত পছন্দের অথবা মতামতের কোন মূল্য দেওয়া হয় না।
ত্রিপুরা
ত্রিপুরা মাহিলারা অন্যান্য উপজাতিদের ন্যায় পিতার এবং স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকারী হন না। কোন বিবাহিত ত্রিপুরা মাহিলার অনৈতিক কার্মকাণ্ডের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সামাজিক আদালতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে স্ত্রীর চরিত্রের সংশোধনের জন্যে ১৫ দিন অন্তর অন্তর তিনবার সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। তিনবার সুযোগ দেবার পরও স্ত্রী চরিত্র সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়।
অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের ন্যায় ত্রিপুরা নারীদের অভিভাবকের মতামতের ভিত্তিতে মেয়েদেরকে বিবাহ দেওয়া হয়, বিবাহের সময়ে বর পক্ষকে কণের মায়ের দুধের ঋণ শোধ বাবদ রূপার পাঁচ টাকা, দুই জোড়া নারিকেল এবং এক বোতল মদ প্রদান করতে হয়। ত্রিপুরাদের মধ্যে ‘‘নাইত”, ‘‘দেনদা” সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী থাকায় এক গোষ্ঠীর ছেলের সাথে অন্য গোষ্ঠীর মেয়ের বিবাহ বা প্রণয় ঘটিত বিষয়গুলো সহজে মেনে নেওয়া হয় না।
তঞ্চঙ্গ্যা
তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতিটি চাকমাদের একটি উপদল। তাদের প্রথাও অনেকটা চাকমাদের মতই, যেখানে নারীর অধিকারকে চরমভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা প্রথা মতে, কোন ব্যক্তি মৃত্যুর পর শুধুমাত্র তার পুত্র বা পুত্র সন্তানরাই মৃত ব্যক্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হন। কন্যা সন্তান কোন প্রকার সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। কন্যা সন্তান পরিবারের অমতে বিয়ে করলে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ বিচার এর ব্যবস্থা করা হয়। বিচারে সাধারণত ১ অথবা ২ মুষ্ঠিতে ধরা যায় এমন শুকর সমাজের সকলকে খাওয়ানোর আদেশ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপমানজনকভাবে সকলের সামনে তাদের জুতার মালা পরানো হয়। তারপর তাদের বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও তাদের স্বামীর সম্পদের কোন অংশ পান না।
চাক
চাক সম্প্রদায়ে পিতার সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসাবে শুধুমাত্র পুত্র সন্তানগণই সম্পদ পেয়ে থাকেন। মেয়ে বা স্ত্রী কেউ কোন সম্পত্তি পান না। সন্তান শুধুমাত্র মেয়ে হলে ঐ ব্যক্তি সম্পত্তি তার ভাই অথবা ভাই এর ছেলেরা পেয়ে থাকে। এই সম্প্রদায়ের নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না, এক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের মহিলারা দেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় গ্রহণ করলেও সমাজ তা গ্রহণ করে না। বৈধ বিবাহ ব্যতিরেকে কোন নারী গর্ভবতী হলে সামাজিক আদালতে গর্ভবতী মহিলার প্রমাণ সাপেক্ষ্যে ভূমিষ্ঠ সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকৃত হলেও ঐ সন্তান পিতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয় না। পরিবারের অমতে নারীরা বিবাহ করলে তাকে পরিবার ও সমাজচ্যূত করা প্রচলন রয়েছে।
খিয়াং
এ সম্প্রদায়ে বিবাহের ক্ষেত্রে পুরুষদেরকে পণ দিয়ে নারীদের বিবাহ করতে হয়। সাধারনত রুপার দশ টাকা প্রদান করার প্রচলন রয়েছে। খিয়াং জনগোষ্ঠীর প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যা সন্তানগণ সম্পদের উত্তরাধিকার হয়ে থাকেন। মৃত পিতার নামীয় সম্পত্তি থেকে পুত্রগণ তিনভাগের দুই ভাগ এবং কন্যাগণ একভাগ সম্পদের উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়ে থাকেন। দত্তক সন্তান চারভাগের একভাগ সম্পদ পেয়ে থাকেন। পুত্রের অবর্তমানে কন্যা সন্তানগণ পিতার সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন।
ম্রো/মুরং
এ সম্প্রদায়ে বিবাহের সময়ে মাহিলাদেরকে পণ দিয়ে ঘরে তুলতে হয় বিধায়, বিবাহ বিচ্ছেদ হলে স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার থাকে না, বরং পণের টাকা সমুদয় ফেরত দিতে হয়। এক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের নারীরা পিতার পরিবারে ফেরত যেতে চাইলেও তাদের পক্ষে পণের টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হয় না বিধায় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতন ও কষ্টের স্বীকার হয়ে থাকেন। এই জনগোষ্ঠীর সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক বিধায় এখানে শুধুমাত্র পুরুষদের কর্তৃত্ব বজায় থাকে যেমন, যেকোন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব, পূজা পার্বণ ইত্যাদি পারিবারিক যেকোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পুরুষদের একক ভূমিকা থাকে।
লুসাই
লুসাই নরীরা স্বামী কিংবা বাবার সম্পত্তি থেকে কোন অংশ গ্রহণ করতে পারেন না।
পাংখোয়া
পাংখোয়া নারীরা পিতা বা স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকারী হন না। এই সম্প্রদায়ের নারীগণ বিবাহের পূর্বে যে পারিবারিক পদবী বা সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হন না কেন, বিবাহের পর তিনি স্বামীর পরিবারের পদবী ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকেন। তবে ‘‘লাল” উপাধী বা কারবারী হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারেন না।
বম
বম সম্প্রদায়ে নারীদের বিবাহের ক্ষেত্রে পুরুষদেরকে মেয়ের পরিবারকে পণ দিতে হয়। সমাজের রীতি অনুযায়ী স্বামীর কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে স্ত্রীকে অর্থ দিতে হয় যা, স্বামীর উত্তরাধিকারের ৫০ শতাংশ। আর যদি স্ত্রীর কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে বিবাহের সময় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত পণ এর সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে হয়। এ সম্প্রদায়ের নারীরা পিতার অস্থাবর সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পেয়ে থাকেন, কোন মেয়ে পালিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের ছেলেদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে সমাজ চ্যূত করা হয়।
খুমী
স্বামীর মৃত্যুর পর খুমী নারীরা মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হতে পারেন না । স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারীর ভরণ পোষণের সকল দায়িত্ব তার ভাইদের বহন করতে হয়। খুমী নারীরা তার পিতা অথবা স্বামীর কোন প্রকার সম্পদের অংশ বিশেষও পান না।
উপজাতি নারীদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে যে অনবদ্য অবদান রয়েছে তা সাধারণত সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিবারের পাশাপাশি সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিশ্চিত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এজন্য সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারী পুরুষের সম অধিকারে বিশ্বাসী ও বাস্তব জীবনে বিশ্বাসী সম্মান ও মর্যাদা প্রদানকারী ব্যক্তিদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।