১৬২১ থেকে ১৬২৪ সাল। বার্মিজরা এই পাঁচ বছরে ৪২ হাজার বাঙালিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কেবলমাত্র ১৬২৯ সালের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৮ হাজার মানুষকে।
মগ দস্যুরা গ্রাম-কে-গ্রাম লুটপাট, হত্যা, লুন্ঠন শেষে অবশিষ্ট সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে দিত। গ্রামের পর গ্রাম তাদের আগুনে ভষ্ম হয়েছে। বিয়ে-পূজা-পার্বন বা বড় উৎসবের সময়ও এই দস্যুরা হাজির হতো। লুটপাট আর হত্যা ছিল এদের নেশা।
ধরে নেয়া লোকজনের হাতের তালু ছিদ্র করে তার ভেতর সরু বেত ঢুকিয়ে দিয়ে বেঁধে জন্তুর মতো গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হত জাহাজের পাটাতনের নিচে। অন্য দেশের বন্দরে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হত তাদের। বাঙালি বিক্রির একাধিক বাজারও ছিল বার্মায়। মগরা চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। সে সময়কার বাঙালি নারীদের দুঃখগাঁথা আর দীর্ঘশ্বাস এখনও অনেক লোকগানে পাওয়া যায়।
ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের-এর ভ্রমণ বৃত্তান্তে এমন ভয়ঙ্কর তথ্যই লেখা রয়েছে। মগের মুল্লুক বলে যে কথা তা এমনি এমনি লোকমুখে আসেনি। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ক্রোনিক’স’-এর বর্ণনায় জানা যায়, ১৭১৮ সালে বার্মার রাখাইন রাজা দক্ষিণ বঙ্গ তছনছ করে অন্তত ১৮০০ জন সাধারণ অধিবাসীদের ধরে নিয়ে যায়। বন্দীদের অমানুষিক উপায়ে রাজার সামনে হাজির করা হয়। রাখাইন রাজা সেখান থেকে বেছে বেছে একদলকে তার নিজের দাস বানায়, অবশিষ্টদেরকে গলায় দিড় বেঁধে ক্রীতদাসের বাজারে বিক্রি করা হয়।
বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা এলাকা ছিল বলতে গেলে মগদের দখলে। উপকূলভাগ থেকে সুদূর ঢাকা পর্যন্ত নদী তীরবর্তী এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। নদী তীরবর্তী কোন বাড়িতে রাতের বেলা আলো জ্বালানো হত না এসব জলদস্যুদের ভয়ে।
১৭৬১ সালে প্রকাশিত রেসলের ম্যাপে দক্ষিণ বঙ্গে বেশ কয়েকটি জনবিরল এলাকার কথা বলা হয়। এতে কারণ হিসেবে ‘মগদের দ্বারা উৎসন্ন’ লেখা হয়েছে। এ সময় গোটা বাকেরগঞ্জ এলাকা প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে গিয়েছিল। প্যারিসে রক্ষিত মোগল আমলের মাঝামাঝি পর্তুগিজদের প্রণীত একটি ম্যাপে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় পাঁচটি সমৃদ্ধ বন্দরের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু মগদের অত্যাচারে এসব বন্দর ও জনপদ পরিত্যক্ত হয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। পরবর্তীতে ১৬৬৩ সালে সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ক্ষমতায় আসলে মগদের বিতাড়িত করা হয় দেশ থেকে।
ঐতিহাসিকভাবেই বার্মিজরা বাঙালিদের মানুষ হিসেবে গন্য করে না। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের যেসব খবর মিডিয়ায় আসছে তা অতিরঞ্জিত নয়। এটা অনেক ক্ষেত্রে সত্য ঘটনার থেকেও অনেক কম। ১৬০০ শতক যারা নির্যাতনের এমন সব নিষ্ঠুর পন্থা জানতো, বর্তমানে তাদের নির্যাতনের ভয়াবহতা উপলব্ধির বিষয়।
বড় বড় কবিদের জন্মও আরাকান রাজসভায়। একাত্তরেও অনেক শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল রোহিঙ্গারা। মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া নয়, এদের আশ্রয় দিয়ে সঠিক ডাটা সংরক্ষণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক শক্তিকে বাধ্য করতে হবে ব্যবস্থা নিতে। বার্মিজরা ঐতিহ্যগতভাবেই বাঙালিদের শত্রু, এটা ভুলে গেলে চলবে না।