বাংলার উপকূল জনশূন্য হয়েছিল মগ দস্যুদের নিষ্ঠুরতায়রোহিঙ্গাদের রক্ত ঝরার ইতিহাস

Related imageবাংলার উপকূল জনশূন্য হয়েছিল মগ দস্যুদের নিষ্ঠুরতায়রোহিঙ্গাদের রক্ত ঝরার ইতিহাস

মিয়ানমার সরকারের দাবি তাদের দেশে রোহিঙ্গা নামে কোনো জনগোষ্ঠী নেই। রোহিঙ্গাদের তারা রোহিঙ্গা বলে স্বীকারও করে না। তাদের দাবি রোহিঙ্গারা এসেছে বাংলাদেশ থেকে। তাই তাদের মতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর বারবার পরিচালিত হয়েছে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। বর্বর এ হত্যাকাণ্ড থেকে প্রতিবারই প্রাণে বাঁচাতে রোহিঙ্গারা মূলত আশ্রয় নিতে চেয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বারবার তাদের এ দেশে প্রবেশে বাধা দিয়ে বলছে, এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। বাংলাদেশ এ সমস্যায় জড়াবে না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। এ দেশে তাদের আশ্রয় দেয়া হবে না।
কিন্তু ইতিহাস কি বলছে? ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদ, নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মতে আরাকান এবং বাংলার সাথে রয়েছে হাজার বছরের দীর্ঘ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যোগসূত্র। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে চট্টগ্রাম থেকে যেমন মানুষ আরাকানে গেছে, তেমনি আরাকানসহ বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকজন চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বাংলার বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে এসেছে। ১৭৮৪ সালে বর্মী বাহিনী আরাকান দখলের পর বর্মী বাহিনীর অত্যাচারে মগ-মুসলিম নির্বিশেষে দলে দলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রবেশ করে। এমনকি বর্মী বাহিনীর হত্যা নির্যাতন থেকে বাঁচতে ১৭৯৮ সালে আরাকানের তিন ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা আশ্রয় নেয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পরও বিপুল আরাকানি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আসে। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় দু’টি জনগোষ্ঠী চাকমা এবং মারমা যে আরাকান ও বার্মা থেকে এসেছে, তা অনেক গবেষণায় প্রমাণিত।
গবেষকদের মতে শত শত বছর আগে দুই অঞ্চলের মানুষের এই আসা-যাওয়ার পর্যায়ে আরাকান ও চট্টগ্রামের মধ্যে এখনকার মতো সীমান্ত বিভাজন সবসময় ছিল না। সুলতানি আমল, ব্রিটিশ আমলসহ বিভিন্ন সময় এসব অঞ্চল একই প্রশাসনের অধীনে ছিল অনেক বার।
১৪০৪ সালে মগধ বংশের যুবরাজ নরমিখলা আরাকানে পিতার সিংহাসনে বসেন। ১৪০৬ সালে তৎকালীন বার্মা রাজা আরাকান আক্রমণ করলে নরমিখলা বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহী রাজবংশ বাংলা শাসন করত এবং তাদের রাজধানী ছিল গৌড় যা বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামে পরিচিত। ১৪৩০ সালে গৌড়ের সুলতান জালালউদ্দিন শাহ (মতান্তরে নাসিরুদ্দিন শাহ) ৩০ থেকে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকানে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বার্মার কাছ থেকে আরাকান দখল করেন। এরপর বিতাড়িত হয়ে বাংলায় আশ্রয় নেয়া নরমিখলাকে আরাকানের ক্ষমতায় বসান। নরমিখলা ইতোমধ্যে মুসলমান হয়ে মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। তিনি গৌড়ের সুলতানের প্রতি অনুগত থেকে আরাকান রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন।
১৪৩০ থেকে ১৫৩০ সাল পর্যন্ত ১০০ বছর আরাকানের শাসকেরা গৌড়ের সুলতানদের কর দিতেন। ১৫৩০ সালের পর গৌড়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে আরাকান রাজারা স্বাধীন হয়ে যান। ১৫৩১ সাল থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত আরাকান ম্রাউক উ রাজবংশের অধীনে ছিল। দীর্ঘ এ সময় পর্যন্ত আরাকানের সব শাসক তাদের নামের সাথে মুসলিম উপাধি ব্যবহার করতেন। গৌড়ের অনুকরণে তাদের মুদ্রার এক পিঠে আরবিতে কলেমা খচিত থাকত। অপর পিঠে রাজার মুসলিম নাম এবং তার ক্ষমতায় আরোহণের সময় উল্লেখ থাকত। সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি। সৈনিকদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্যও ছিল মুসলমান।
১৫৩০ সালে ম্রাউক বংশের মিনবিন জেবুক শাহ নাম ধারণ করে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। মোগলদের বাংলা আক্রমণে গৌড়ের স্বাধীন রাজশক্তির সমাপ্তি ঘটায় জেবুক শাহ এ সময় আরাকানকে পূর্ণ স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে গৌড়ের অধীনতা মুক্ত হলেও মোগলদের নিয়ে ভীত হয়ে পড়েন জেবুক শাহ।
মোগলদের মোকাবেলায় ১৫৩১ সালে জেবুক শাহ পর্তুগিজ নৌসেনাদের সহায়তায় মগদের নিয়ে নৌবাহিনী গঠন করেন। এই মগ নৌসেনেরা পরে হিংস্র জলদস্যুতে পরিণত হয়। নৌবাহিনীতে মুসলমানদের পরিবর্তে মগদের স্থান দেয়া হয়। কারণ জেবুক শাহ মনে করতেন মোগলরা মুসলমান। তাই মুসলমানদের দিয়ে নৌবাহিনী গঠন করা হলে তারা মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না-ও করতে পারে।
মেঘনা নদীর মোহনা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূল এমনকি মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত নির্বিচার লুণ্ঠন আর হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে মগ জলদুস্যরা। তাদের অত্যাচার, হত্যা আর লুণ্ঠনের কারণে বিস্তীর্ণ এ উপকূলভাগ জনশূন্য হয়ে যায়। মগ জলদুস্যরা আক্রমণ করে হত্যা, লুণ্ঠনের পর জ্বালিয়ে দিত জনপদের পর জনপদ। এ সময় অগণিত মুসলমান নরনারীকে তারা ধরে নিয়ে যায় আরাকানে এবং তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করে। ধরে নিয়ে যাওয়া মুসলমানদের ব্যবহার করা হয় গভীর অরণ্য পরিষ্কার করে কৃষিকাজের মতো কঠিন কাজে। এভাবেও এ সময় বিপুল মুসলমানের আগমন ঘটে আরাকানে। মগ জলদস্যুরা এ সময় যাদের ধরে নিয়ে দাসে পরিণত করে তাদের ওপর নির্মম অত্যাচারের বিবরণ রয়েছে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে।
ঐতিহাসিক ভ্যান লি ছোটেন লিখেছেন জলদস্যুরা ছিল বন্য জন্তুর মতো বর্বর। ন্যায়নীতি বলতে কিছু ছিল না তাদের। সমকালীন ইতিহাসবিদদের লেখায় বাংলার উপকূলের নরনারীদের প্রতি মগ জলদস্যুদের নিষ্ঠুর অত্যাচার, হত্যা আর ধরে নিয়ে দাসে পরিণত করার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা শিউরে ওঠার মতো এবং লোমহর্ষক।
এন এম হাবিব উল্লাহ ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, এককালে বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, নোয়াখালী অঞ্চল ঘনজনবসতিপূর্ণ ছিল। গৌড়ের শাসকেরা এ অঞ্চল থেকে বিপুল রাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু মগ জলদস্যুদের অত্যাচারে এসব এলাকা এক সময় আবার জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়। সমকালীন ঐতিহাসিক শিহাব উদ্দিন তালিশ মগ দস্যুদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, মেঘনা নদীর মোহনা থেকে অববাহিকা ঊর্ধ্বদেশে প্রবেশ করে মগ দস্যুরা গ্রামের পর গ্রাম লুট করে জ্বালিয়ে দিত। গৃহপালিত পশুরাও এদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না। গ্রামবাসী নারী-পুরুষ শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে লোকজনদের ধরে দস্যুরা এক জাগায় জড়ো করত। অতঃপর গরম লোহার শিক দিয়ে দস্যুরা তাদের হাতের তালু ছিদ্র করত। তারপর চিকন বেত ছিদ্রপথে চালিয়ে দিয়ে বেঁধে ফেলত। বেতের অপর মাথা ধরে সবাইকে জাহাজের কাছে নিয়ে গিয়ে পাটাতনে ফেলে রাখত। মুরগিকে যেভাবে সিদ্ধহীন চাল ছিটিয়ে দেয় তদ্রƒপ বন্দীদের ওপর চালত সকাল-বিকাল জাহাজের ছিদ্রপথে ছিটিয়ে দিত। এহেন অত্যাচারের পর যেসব লোক বাঁচত তাদের আরাকানে নিয়ে গিয়ে কৃষিকাজে নিয়োজিত করত। অনেককে দাস হিসেবে বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে দিত। এমনকি অনেক সৈয়দ বংশীয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনকেও এহেন অবমাননাকর জীবনযাপন করতে হয়েছে।
এ ছাড়া মেনরিকের লেখায়ও বাংলার উপকূল ভাগ থেকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা লোকজনকে ধরে আরাকানে নিয়ে যাওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ধরে নিয়ে যাওয়া মুসলমানদের ধর্মান্তর করারও চেষ্টা করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব ‘বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতি’ নামক বইয়ে লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী কোনো জনগোষ্ঠীই এখানকার কোনো আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়। লেউইন ১৮৬৯, খিশা ১৯৬৪, বার্নট ১৯৬০ এবং আহমদ ১৯৯০ প্রমুখের গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জনগোষ্ঠীই আগে বা পরে পাশের অথবা একটু দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল বা সমতল ভূমি থেকে দেশান্তরি হয়ে ওইসব অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং নিবাস গড়ে তোলে। ... উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমারা মিয়ানমার এবং দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মারমারা আরাকান থেকে এসেছে।
চাকমারা মোগল শাসনামলের শেষ দিকে এবং ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে প্রবেশ করে। লেউইনের মতে ১৭৮৪ সালে মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।
ব্যোমরা মিয়ানমার-চীন পর্বত থেকে নিয়ে তাশন পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠী প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ এবং হিংস্র দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে তাদের পুরাতন বসতিস্থান থেকে এখানে পালিয়ে এসেছে। নতুবা এক জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর পশ্চাদ্ধাবন করে আক্রমণকারী হিসেবে এ দেশে প্রবেশ করেছে। হাটচিংসন ১৯০৯, বার্নট ১৯৬০ ও রিসলি ১৯৯১।