মান্দালয়ের একটি বৌদ্ধ মঠের ভেতরে পাঁচ কিশোর একটি পোস্টারের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। শিশুর লাশ, রক্তস্নাত সন্ন্যাসী, অস্ত্র হাতে ক্রুদ্ধ জিহাদিদের ছবি নিয়ে এই পোস্টারটি তৈরি করা হয়েছে। তখনই গেরুয়া পোশাক পরা এক সন্ন্যাসীর উদয় হলো। সে বলল, ‘মুসলিমরা আসলে কেমন, এই পোস্টার সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।’
ম্যাসোইইন মঠের সবচেয়ে বিখ্যাত অধিবাসীর নাম অশিন বিরাথু। ধ্যান অধিবেশনের বিরতির সময় সে এই বিষয়টিই বিশদভাবে ব্যাখ্যা করল। জানল, বৌদ্ধ ধর্ম রয়েছে ভয়াবহ বিপদে।
উল্লেখ করলে, কয়েক শ’ বছর আগে ইন্দোনেশিয়া ছিল মূলত হিন্দু ও বৌদ্ধ দেশ। পরে দেশটির ইসলামের কাছে ‘পতন’ ঘটেছে। আর ফিলিপাইন জিহাদি ‘দলগুলোর’ যুদ্ধের কবলে পড়েছে। সে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলে, এরপর মিয়ানমার। ‘অরগানাইজেশন ফর প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়নের’ সবচেয়ে চরমপন্থী নেতা হল এই বিরাথু। তার সংগঠনটি অবশ্য মিয়ানমারে ‘মা বা থা’ নামেই বেশি পরিচিত। বর্মি বৌদ্ধদের তার কথিত ইসলামের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে বক্তৃতায় আগুনের ফুলকি ছোটাচ্ছে।
মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধরা যাদের লক্ষ্য করে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে তারা মূলত মুসলিম এবং আরো বিশেষ করে এই রোহিঙ্গারা। মুসলিমদের বাড়িঘর, মসজিদ এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর সাম্প্রতিক বেশ কিছু হামলা হয়েছে। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নির্যাতন চালানো হয়। এতে প্রায় ২০০ নিহত হয়। নিহতদের বেশির ভাগই মুসলিম। জাতিসঙ্ঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রুপ বলছে, সৈন্যরা ভয়াবহ মাত্রায় ধর্ষণ, খুন এবং রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মিয়ানমার জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ হলো বৌদ্ধ। তাদের সংখ্যা কমছে- এমন কোনো প্রমাণ নেই। সন্ন্যাসীত্বপ্রাপ্ত বা সঙ্ঘের সদস্য হওয়াটা দেশটিতে বেশ জনপ্রিয়। তাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ তথা জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশই সন্ন্যাসী। দেশটির নেত্রী অং সান সু চি নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ।
বিরাথুর আইডিয়াগুলো মিয়ানমার সরকারের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেনা-প্রাধান্যবিশিষ্ট আগের সরকার মা বা থার এজেন্ডার আলোকে চারটি আইন পার্লামেন্টে পাস করিয়েছিল। একটি আইনে তিন বছরের আগে নতুন শিশুর জন্ম না দিতে মুসলিম পিতামাতাদের বলা হয়। আরেকটি আইনে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। অপর দু’টি আইনে ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য মিয়ানমারে ধর্মান্তর এমনিতেই বিরল ঘটনা। কিন্তু তারপরও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন বেশ কঠোর। কেউ যদি ধর্ম পরিবর্তন করতে চায় তবে তাকে লিখিতভাবে কর্র্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। কর্তৃপক্ষ তার সাক্ষাৎকার নেবে। আর বৌদ্ধ কোনো নারী যাতে তার ধর্মের বাইরে কাউকে বিয়ে করতে না পারে, সে জন্যও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে।
নতুন, বেসামরিক সরকারের আমলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এই সরকার দাঙ্গাবাজদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইয়াঙ্গুনে মসজিদ ও মাদরাসা বন্ধ করে দিতে আমলাদের অনুমতি দিয়েছে। মুসলিমরা যখন মসজিদ বন্ধের প্রতিবাদে রাস্তায় নামাজ পড়েছে, তখন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ‘স্থিতিশীলতা নষ্ট এবং আইনের শাসনের প্রতি হুমকি’ সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে।