পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সাথে শান্তিবাহিনী থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের গোপন সম্পর্কের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শান্তি চুক্তির পর শান্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণকারী সদস্যদের চাকরি দিয়ে পুলিশে পুনর্বাসন করা হলেও তাদের অনেকেই এখনো ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সশস্ত্র সংগঠনগুলো এদের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার আগাম তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি এ সব সংগঠনের অস্ত্র আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘উপজাতি’ পুলিশের একাংশকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শেখ মো. মিজানুর রহমান বলেন, পাহাড়ি কিছু পুলিশ সদস্যের মধ্যে তাদের পুরনো ঐতিহ্য লক্ষ্য করা গেছে। তারা মদপানসহ বিভিন্ন কারণে পাহাড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এর মধ্যে যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ অভ্যন্তরীণ তথ্য পাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতির গেরিলা সংগঠন শান্তিবাহিনীর অনেক সদস্য তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এদের একাংশকে পুলিশের বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়া হয়। শান্তিবাহিনী থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের শুরুতে সমতলের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাবর্ত্য অঞ্চলে বাঙালী ও পাহাড়ি পুলিশের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১২ সালে ‘উপজাতি’ পুলিশ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন জেলা ও ইউনিট থেকে পার্বত্য অঞ্চলে বদলি করা শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ৯০ জনকে বদলি করা হয়েছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শান্তিবাহিনী থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের পার্বত্য অঞ্চলে বদলি করার পর এদের অনেকেই পুরনো যোগাযোগ ধরে নতুন করে জনসংহতি সমিতির দুই গ্রুপ এবং ইউপিডিএফের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।
পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সংগঠনের গোপন সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে জনসংহতি সমিতির (সংস্কার গ্রুপ) সভাপতি সুধাসিন্ধু খিসা বলেন, পাহাড়ি পুলিশ পাহাড়ে থাকলে অপরাধ করবে আর সমতলে থাকলে অপরাধ করবে না এমন ভাবনা যৌক্তিক নয়। পুলিশের যারা অপরাধ করবে তারা পাহাড়ি হলেও করবে বাঙালী হলেও করবে। বাঙালী অনেক পুলিশ তার পরিবারের সদস্যদের সহায়তা দেয়।
তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ কর্মকর্তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় উপজাতি পুলিশ সদস্যদের খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন থানা ও ইউনিটে মোতায়েন করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। উল্টো পার্বত্য অঞ্চলকে তারা ‘হোমগ্রাউন্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। আত্মসমর্পণকৃত বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীতে পুনর্বাসিত উপজাতীয় সদস্যদের মধ্যে যারা পার্বত্য এলাকায় দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হন, তাদের একটা বড় অংশকে কুচক্রীমহল তাদের পূর্বোক্ত সংগঠনের কার্যক্রমের সাথে গোপনে ও পরোক্ষভাবে জড়িত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। উপজাতীয় পুলিশ সদস্যরা পার্বত্য জেলায় চাকরির সুবাদে আঞ্চলিকতা, আত্মীয়তা ইত্যাদি প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। পূর্বের সংগঠনের সঙ্গে গোপন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে।’
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুসারে, ‘উপজাতীয় পুলিশ আঞ্চলিকতা এবং পূর্বের দলীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে গোপনীয়, স্পর্শকাতর, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত গোপন তথ্যাদি বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের কাছে পাচার করছে। এমনকি উপজাতীয় পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে প্রাপ্ত স্পর্শকাতর তথ্য ইউপিডিএফ, জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (সংস্কার) এর মতো আঞ্চলিক সংগঠনে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, জননিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়ছে।’
পার্বত্য অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ওই অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে মদ তৈরি ও সেবনের সংস্কৃতি চালু আছে। তারা নিজেরাই তামাক চাষ করে এবং তামাক ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন করে। শান্তি চুক্তিপরবর্তী সময়ে পুলিশ বিভাগে চাকরি পাওয়া উপজাতীয় পুলিশ সদস্যরা পার্বত্য অঞ্চলে বদলি হয়ে কাজে যোগদানের পর মদ ও গাঁজা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ কাজের জন্য তারা স্থানীয় পাহাড়িদের সাথে গোপনে মেলামেশা করছে। ফলে সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সাথে তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশবাহিনীর নিরাপত্তা পরিকল্পনা, দিকনির্দেশনামূলক তথ্য উপজাতীয় পুলিশ সদস্যরা উপজাতীয় সংগঠনগুলোর সদস্যদের কাছে আগাম প্রকাশ করে দেয়। ফলে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও দুরূহ হয়ে পড়ে।
শান্তিবাহিনী থেকে পুলিশে যোগ দেওয়া সদস্যরা তাদের জন্য বরাদ্দ সরকারি অস্ত্র, গুলিসহ অন্যান্য মালামাল সম্পর্কেও যত্নবান নয়, উল্লেখ করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় কর্মরত উপজাতীয় পুলিশ সদস্য পুলিশ লাইন্সে অবস্থান না করে ইউপিডিএফ অধ্যুষিত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে। ফলে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনেকের আত্মীয়তার সুবাদে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কাছে পৌঁছে যায়। এ সব পুলিশকে পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে পুলিশ লাইন্স এবং আশপাশের এলাকায় বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য বলা হলেও তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বাসা পরিবর্তন না করে ইচ্ছেমাফিক পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করছেন।’
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ‘গত বছরের ২৫ অক্টোবর ভোরে রাজধানীর কাফরুলের একটি বাসা থেকে ৫শ’ রাউন্ড গুলিসহ জেনাল চাকমা ও প্রেম চাকমাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সব গুলি বিক্রির জন্য তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল।’
অন্যদিকে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার কুড়াদিয়াছড়া পূজামণ্ডপে দায়িত্বরত পুলিশের নায়েক লক্ষ্মী কুমার চাকমার কাছে থাকা এসএমজি (সাব মেশিনগান) চুরি হয়ে যায়। ঘটনার ২১ দিন পর ২৫ অক্টোবর খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের নালকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের পুকুর থেকে অস্ত্রটি বস্তাবন্দী অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নায়েক লক্ষ্মীকুমার চাকমাসহ ৭ জনকে গ্রেফতার ও আর্মড পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) কিরণ চাকমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতি পুলিশ সদস্যদের তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সুশৃঙ্খল বাহিনী। তাদের কোনো বর্ণ, জাতি কিংবা গোষ্ঠী নেই। পুলিশে যোগদানের পর প্রতিটি সদস্য তার নিজ ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করে পুলিশের শৃঙ্খলা ও পুলিশী গোপনীয়তা রক্ষা করবে।
আইজিপি বলেন, পাহাড়ি কিংবা বাঙালী নয়, পুলিশের মধ্যে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলেই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আবার অনেক ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।