মিয়ানমারের উগ্রপন্থীদের নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নতুন মিশন
পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ‘উগ্রপন্থী’ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। মিয়ানমারের ‘নাইন সিক্স নাইন’-এর আদলে বাংলাদেশেও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে মিয়ানমার থেকে প্রশিক্ষণও নিয়ে আসছেন এই তৎপরতায় যুক্ত ভিক্ষুরা।
ভিক্ষুদের উগ্রপন্থী তৎপরতায় সহায়তার জন্য ‘নাইন সিক্স নাইন’-এর বেশ কয়েকজন সদস্য ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ঘুরে গেছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধমের তথ্যানুসারে, সাধারণত ‘৯৬৯’ বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত। সংখ্যা তিনটি যথাক্রমে গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ সংঘের প্রতীক। তবে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উগ্রপন্থী আন্দোলন সারাবিশ্বে ‘নাইন সিক্স নাইন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই আন্দোলনের প্রধান সংগঠক আশিন ভিরাথু। তিনি মিয়ানমারের বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার মূল উস্কানিদাতা হিসেবেও অভিযুক্ত। তাকে নিয়ে ‘দ্য ফেস অব বুড্ডিস্ট টেরর’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘টাইম’ সাময়িকী। গত বছরের জুন সংখ্যার প্রচ্ছদে আশিন ভিরাথুর ছবিও ছাপা হয়।
এ ছাড়া বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সরকার ‘নাইন সিক্স নাইন’-এর তৎপরতায় সমর্থন দিচ্ছে।
মিয়ানমারে তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি ‘নাইন সিক্স নাইন’ প্রতিবেশী দেশগুলোতে বৌদ্ধ মৌলবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির উস্কানিতে বাংলাদেশের কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় এক বছর আগে বাংলাদেশী বেশকিছু উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু মিয়ানমারে আশ্রয় নেন। ওই সময় তারা মিয়ানমারে ‘নাইন সিক্স নাইন’-এর সদস্যদের কাছে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলের ভিক্ষুদের মিয়ানমারে যাতায়াত বেড়েছে। প্রতিমাসে অন্তত ১৫-২০ জন ভিক্ষু মিয়ানমার যাচ্ছেন। যাতায়াতের জন্য ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে অরক্ষিত সীমান্ত অঞ্চল মিজুরাম ও থানচি এলাকা ব্যবহার করছেন তারা। ক্ষেত্র বিশেষেও মিয়ানমারের ‘নাইন সিক্স নাইন’ আন্দোলনের কর্মীরা বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছেন।
তবে বৌদ্ধদের উগ্রপন্থী তৎপরতার এ সব তথ্য সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন দ্য ওয়ার্ল্ড বুদ্ধ শাসক সেবক সংঘের নেতা অনুপম বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ ধরনের তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সূত্র জানায়, এ বছরের ১২ জুলাই রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুনধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজার এলাকায় অং কেং চাকমা নামে মিয়ানমারের এক নাগরিককে আটক করে বিজিবি ১৭ ব্যাটালিয়নের তুমব্রু বিওপির টহল দল। তার গ্রামের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু জেলার ডেকুবুনিয়া থানার জুস্যাখালী ইউনিয়নের সাংবালায়। অং কেং চাকমা বাংলাদেশের তুমব্রু সীমান্তবর্তী পিলারের কাছে কাঁটাতারের বেড়ার দুর্বল অংশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করে তুমব্রু হেডম্যানপাড়ার হেডম্যান পু চাকমার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাতে তুমব্রু বাজারে বিক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা করায় বিওপির টহল বিজিবি দল তাকে আটক করে।
বিজিবি সূত্র জানায়, তুমব্রু এবং বাইশফাঁড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে বেশ কয়েকবার অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে অং কেং। বাইশফাঁড়ি এলাকার কারবারি কেওলা চিং চাকমা তার মামা।
বিজিবি সদর দফতরে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অং কেং মিয়ানমারের ‘নাইন সিক্স নাইন’ গ্রুপের সদস্য। তিনি বাংলাদেশী সীমান্তে তৎপর ১০ সদস্যের একটি উপদলের নেতা। এই উপদলের সদস্যদের মধ্যে অং লা, মং ইয়ে সা, মং তে, মং কিয়াও প্রু এবং হ্লা তুনের নাম পাওয়া গেছে। এরা সবাই মিয়ানমারের নাগরিক। বান্দরবানের উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু উচ হ্লা ভান্তের সঙ্গে তার নিজের এবং পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে বলে অং কেং বিজিবির কাছে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
উচ হ্লা ভান্তের সঙ্গে ‘নাইন সিক্স নাইন’-এর তৎপরতার সম্পর্ক থাকার অভিযোগ রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
এ বিষয়ে উচ হ্লা ভান্তের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার কার্যালয়ের টেলিফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। উচ হ্লা ভান্তেকে খুদেবার্তা পাঠিয়েও প্রত্যুত্তর মেলেনি।
উচ হ্লা ভান্তের ঘনিষ্ঠ শিষ্য বাচা মংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘উচ হ্লা ভান্তের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণ অহিংস। এখানে সশস্ত্র তৎপরতা বা উগ্রপন্থার স্থান নেই।’
ধর্মীয় কারণে মিয়ানমারে যাতায়াতের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বৈধ পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভিক্ষুরা বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশগুলোতে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় ভিক্ষুরা মিয়ানমারে বেশি যান। মিয়ানমার সরকার ক্যাং (বৌদ্ধ বিহার) পরিচালনার জন্য উচ হ্লা ভান্তেকে সে দেশে জমি দিয়েছেন। ধর্মীয় কাজে তিনি মাঝে মধ্যেই সেখানে যান।’
এদিকে মিয়ানমার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার অভিযোগে গত ৯ জুলাই বাংলাদেশী প্রকাশ চাকমা ও সুময় চাকমা নামে দুই বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আটক করে বিজিবি। তাদের গ্রামের বাড়ি রাঙ্গামাটি সদরের বালুখালী ইউনিয়নের বসন্ত মইন পাড়ায়। প্রকাশ চাকমা এবং সুময় চাকমা চাচাত ভাই এবং একই ধর্মগুরুর শিষ্য।
বিজিবির কক্সবাজারের ১৭ ব্যটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম দুই ভিক্ষুকে আটকের বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ভিক্ষুদের প্রথাগত গেরুয়া বসন পরিহিত এই দুই ব্যক্তির ব্যাগ এবং পরিধেয় তল্লাশি করে মিয়ানমারে উৎপাদিত প্যাকেটজাত খাদ্যসামগ্রী, বার্মিজ ভাষায় রচিত পুস্তক, মিয়ানমারের মানচিত্র, ব্যবহৃত সাধারণ ও উন্নতমানের এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল হ্যান্ডসেট, ট্যাবলেট কম্পিউটার (ট্যাব), বাংলাদেশী মোবাইল অপারেটরের সিম কার্ড, মেমোরি কার্ড, পেনড্রাইভ, সিডি, হাইডেফিনিশন ভিডিও ক্যামেরা, ডিজিটাল কম্প্যাক্ট ক্যামেরা এবং দেশীয় টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা (ভারতীয় রুপি, সিঙ্গাপুর ডলার, মার্কিন ডলার, মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত) পাওয়া যায়। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগের আলামত পাওয়া গেছে।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা ভান্তেদের হয়ে কাজ করার জন্য ‘উপজাতি’ যুবকরা সম্প্রতি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা থেকে কক্সবাজার-নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে মিয়ানমার যাওয়া আসা করছেন। অপরদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অবস্থানরত মিয়ানমার নাগরিকদের সঙ্গে নিবিড় ও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে নিয়মিত নাইন সিক্স নাইনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে ভান্তেদের চলাচলে ব্যবহৃত যানবাহন তল্লাশি করে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে উগ্রপন্থী ভান্তেরা অস্ত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ আনা-নেওয়া করে।
জানা গেছে, গত বছরের প্রথমদিকে মিয়ানমারের সিং প্রদেশে ‘নাইন সিক্স নাইন’-এর নেতা ভিরাথুর সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ভিক্ষুর বৈঠক হয়। ওই বৈঠক থেকেই বাংলাদেশী ভিক্ষুদের মিয়ানমার গিয়ে সশস্ত্র সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু হয়। মিয়ানমারের ‘নাইন সিক্স নাইন’ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত ভিক্ষুদের একাধিক ছবি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। প্রশিক্ষণরত এই ভিক্ষুদের কেউ বাংলাদেশি কিনা, তা জানতে ইতোমধ্যেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।
বিজিবির কক্সবাজারের ১৭ ব্যটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, সীমান্ত ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা আছে, সরকারকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। আশা করি খুব শিগগিরই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। এ ছাড়া বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তৎপরতার বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি, তবে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় ভিক্ষুরা বসবাস করায় তারা গোপনে বাংলাদেশীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। বিজিবির টহলের কারণে তারা অনেক সময় সফল হন না।’
http://archive.is/gIJyV