উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসী সুচিঃ এক মানুষরুপী হিংস্র হায়েনার নাম

Related imageউগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসী সুচিঃ এক মানুষরুপী হিংস্র হায়েনার নাম
২০১২ সালের ১২ জুন নরওয়ের রাজধানী অসলোতে নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়ে অং সান সু চি বলেছিলেন, মিয়ানমারে দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকার সময় তিনি শক্তি অর্জন করতেন জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার প্রস্তাবনা অনুচ্ছেদের এই কথাগুলো থেকে: ‘মানবাধিকারের প্রত্যাখ্যান ও ঘৃণার ফলে বিশ্বজুড়ে যে বর্বরতার সূত্রপাত হয়, তা থেকে মানুষের বিবেকে জেগে ওঠে প্রবল প্রতিরোধ। সেই প্রতিরোধ থেকে জন্ম নেয় মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা, যেখানে স্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে এমন এক বিশ্বব্যবস্থার প্রতি সমর্থন, যেখানে প্রত্যেক মানুষ বাক্স্বাধীনতা ও ধর্মবিশ্বাস প্রতিপালনের অধিকার ভোগ করবে এবং ভীতি ও অভাব থেকে মুক্তির অধিকার অর্জন করবে।’
অনুমান করি, এই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শুধু নিজেকে নয়, পৃথিবীর যেখানেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়, সেখানকার অধিপতিদের মানবাধিকারের এই ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। খুব ভালো হয় সু চি যদি এখন সে কথা নতুন করে নিজেকে মনে করিয়ে দেন। কারণ, তাঁর নিজের দেশের এক সম্প্রদায়ের মানুষের মানবাধিকার আজ চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি এখন আর কারাগারে বন্দী নন, কার্যত ওই দেশের শাসনকর্তা। সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকানোর ক্ষমতা তাঁর রয়েছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর যে সংগঠিত আক্রমণ চলছে, তা গণহত্যা বা জেনোসাইড ভিন্ন অন্য কিছু নয়। দেশটির ১৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে সরকারিভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সে দেশের প্রায় ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে রোহিঙ্গা অন্যতম। কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদের বৈধ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এমনকি সরকারি জনসংখ্যা গণনার সময় রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব ধরনের মৌলিক মানবাধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সরকারি সমর্থনে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী লোকদের হাতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা চলছে। তাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, মসজিদ, স্কুলঘর বা দোকান—কোনো কিছুই তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। অনেকে ডিঙিনৌকা নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে মারা গেছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দিচ্ছে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু, তাঁর নাম ভিরাথু। টাইম ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, তিনি নিজেকে মিয়ানমারের বিন লাদেন বলে ঘোষণা করেছেন। বিন লাদেন আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু ভিরাথুর যুদ্ধ নিজ দেশের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। যে সন্ত্রাসী দলটির নেতৃত্বে তিনি রয়েছেন, একসময় তার নাম ছিল ৯৬৯ আন্দোলন। এখন দেশের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে তার নতুন নাম হয়েছে মা বা থা। নাম যেটাই হোক, ভিরাথু ও তাঁর দলের একটাই লক্ষ্য, প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে হয় নির্মূল অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা। রোহিঙ্গাদের সম্বন্ধে ভিরাথু একসময় মন্তব্য করেছিলেন, এই লোকগুলো শৃগালের মতো, তারা তখনই ভদ্র ব্যবহার করে, যখন তাদের বেকায়দায় ফেলা হয়।
মিয়ানমারের অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মতো রোহিঙ্গারাও বহিরাগত। আনুমানিক ৬০০ বছর আগে প্রথম রোহিঙ্গা মুসলমানরা সুলতানি বাংলা থেকে আরাকানে গিয়ে বসত গড়ে। আরাকানি রাজা নরমেখলা নিজ রাজ্য হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন শাহের রাজত্বে, ১৪৩০ সালে তাঁর সাহায্যে নরমেখলা তাঁর রাজ্য ফিরে পান। বাংলা থেকে ফেরার সময় আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে করে যাদের তিনি নিয়ে যান, পরে তারাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত হয়। এখানে মনে রাখা ভালো, রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যাগুরু বামাররাও বহিরাগত। আনুমানিক ১ হাজার ২০০ বছর আগে তারা তিব্বত ও চীনের পার্বত্যাঞ্চল থেকে ইরাবতী উপত্যকায় গিয়ে বসড় গড়ে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বামারদের নির্মূল অভিযান আজকের নয়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সমর্থনে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের নির্দেশে অর্ধশতক ধরে এই পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ চলে আসছে। সত্তর ও আশির দশকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের অনুপ্রবেশের ফলে এই সংকট এক নতুন চরিত্র অর্জন করে। এর ফলে কোন আন্তর্জাতিক চক্র কীভাবে কতটা লাভবান হয়েছে এবং বাংলাদেশ কীভাবে সে খেলার পাশার ঘুঁটি হয়ে উঠেছে, তার হিসাব অন্য সময় করা যাবে। মোদ্দা কথা হলো, সন্ত্রাসী খেদাও অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলায় এই সম্প্রদায়ভুক্ত সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠল। সেই থেকেই ক্রমবর্ধমান হারে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের প্রধান পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কসমূহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। তিন-চার সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যেসব ভিডিও দেখানো হয়েছে, তাতে যেকোনো সুস্থ মানুষের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই আক্রমণকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা জাতি-সম্প্রদায়গত নির্মূল অভিযান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মিয়ানমার প্রশ্নে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি বিজয় নাম্বিয়ার বলেছেন, শুধু মুসলিম নাগরিকদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য করে সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। ‘এথনিক ক্লিনজিং’ কথাটি নাম্বিয়ার ব্যবহার করেননি, সেটি করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশনারের প্রতিনিধি জন ম্যাককিসিক। দুর্গত অঞ্চল সফর শেষে তিনি বলেছেন, সামরিক অভিযানের ফলে হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়েছে, আগুনে জ্বলে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে, বিপদ জেনেও তারা এপারে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমারে এখন যা হচ্ছে, তা ‘এথনিক ক্লিনজিং’ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
সবচেয়ে যা বিস্ময়কর তা হলো, সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই অভিযানে অংশগ্রহণ করছে মিয়ানমারের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ, যাদের একসময় নিতান্তই শান্তিকামী ভাবা হতো। বৌদ্ধধর্মে শুধু মানুষ নয়, যেকোনো প্রাণী হত্যাই ভয়ানক অপরাধ। অথচ ভগবান বুদ্ধের সেই অনুসারীরাই এখন পুরো একটা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই অভিযানকে গণহত্যা বা জেনোসাইড বলা হলে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের গণহত্যাবিরোধী কনভেনশন বা চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে অংশত বা সম্পূর্ণ ধ্বংসের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা ‘গণহত্যা’ বা ‘জেনোসাইড’ নামে পরিচিত হবে। জাতিসংঘ এখনো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযোগ তোলেনি, কিন্তু মিয়ানমারে যা হচ্ছে, তা গণহত্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়। স্মরণযোগ্য যে মিয়ানমার হচ্ছে এই চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এখন তারাই সে চুক্তি নির্বিচারে লঙ্ঘন করে চলেছে।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় বলে ব্যাখ্যা করেছে। এমনকি অং সান সু চি, যিনি এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অঘোষিত রাষ্ট্রপ্রধান, তিনিও এই নির্মূল অভিযানের একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি টোকিও গিয়েছিলেন জাপানি সাহায্য চাইতে। সেখানে তাঁকে রোহিঙ্গা অভিযানের ব্যাপারে সরাসরি প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ, তাঁর মতে, এ ব্যাপারে সরকারি তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কী অদ্ভুত কথা! সারা বিশ্ব যেখানে দেখছে সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও দাঙ্গাবাজ রাজনৈতিক দলের সদস্যদের হাতে নির্বিচারে নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হচ্ছে, আগুনে পুড়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, সেখানে সু চিকে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে অপেক্ষা করতে হবে সরকারি তদন্তের প্রতিবেদনের জন্য?
গত শনিবার সিঙ্গাপুরের একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সু চি পুরো ঘটনার জন্য উল্টা গণমাধ্যমকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পক্ষপাতমূলকভাবে একটানা নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। তাঁর দাবি, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই শান্ত।
সরকারি তদন্তের ফল কী হবে, তার আলামত মিলেছে এই তদন্তের সভাপতি উ আং উইনের একটি মন্তব্য থেকে। রোহিঙ্গা নারীদের ওপর নির্বিচার ধর্ষণ চলছে, সে অভিযোগের প্রমাণ তাঁর কাছে হাজির করা হলে আং উইনের উত্তর ছিল, ‘অসম্ভব, আমাদের সৈন্যরা এই কাজ করতে পারে না। কারণ, রোহিঙ্গা মেয়েরা “নোংরা”!’
এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে বৌদ্ধ ভিক্ষুর নেতৃত্বে মিয়ানমারের জাতীয়বাদী শক্তিগুলো এই অভিযানে অংশ নিচ্ছে, সেই ভিরাথুকে জাতীয় বীরের সম্মান দিয়েছে দেশের বিগত সামরিক সরকার। এমনকি অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির অনেক কর্তাব্যক্তিও ভিরাথুর মা বা থা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাবেক সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান থেইন সেইন এমন কথাও বলেছেন যে এই আন্দোলন আসলে ‘শান্তির এক প্রতীক’ এবং এই আন্দোলনের নেতা ভিরাথু ‘ভগবান বুদ্ধের সন্তান’। দেশের বাইরেও বর্মিরা ভিরাথুকে বীরের সম্মান দেখিয়েছে। ২০১৪ সালে লন্ডনে বর্মিদের সর্ববৃহৎ উপাসনালয় সাসানা রামসি ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায়’ অবদানের জন্য ভিরাথুকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করে।
ভিরাথু ও তাঁর দল যে অভিযান শুরু করেছে, তা শুধু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নয়, ইসলামের বিরুদ্ধেও। এই দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা উ পামাউখা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের সঙ্গে তঁাদের আন্দোলনের সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যত দিন ইসলাম থাকবে, তত দিন সন্ত্রাসী থাকবে, তাই আমরা ট্রাম্পের মতোই আমাদের দেশ ও ধর্মকে ইসলামের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য লড়ছি।’
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। চীনসহ প্রধান শক্তিগুলোর কেউই সামরিক বা অর্থনৈতিক অবরোধের কথা বিবেচনায় আনেনি। বাংলাদেশের উচিত হবে তেমন দাবি তোলা। আশু ব্যবস্থা হিসেবে সে দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য সব রকম আন্তর্জাতিক ঋণ ও উন্নয়ন সাহায্য স্থগিত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে জাতিসংঘসহ সব বহুপক্ষীয় ফোরামে এই প্রশ্ন তোলা। গত মাসে সু চির টোকিও সফরের সময় জাপান সরকার তাঁর সরকারের সঙ্গে ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের এক উন্নয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আমাদের উচিত হবে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত সেই উন্নয়ন সাহায্য স্থগিত রাখার