ইউপিডিএফের নতুন শাখার লক্ষ্য অস্ত্রবাণিজ্য

Related imageইউপিডিএফের নতুন শাখার লক্ষ্য অস্ত্রবাণিজ্য


পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবির সংগ্রাম চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সংগঠনটি।

তাদের এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে সংগঠনকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা। অস্ত্রের চালান আনা-নেওয়ার পথ সুগম করতে ইতোমধ্যে টেকনাফ ও কক্সবাজারে পৃথক দুটি শাখা গঠন করেছে ইউপিডিএফ। সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের একটি হোটেলে এ নিয়ে বৈঠক করে গেরিলা সংগঠনটির কয়েক শীর্ষ নেতা। মিয়ানমারের একটি সশস্ত্র সংগঠনের একাধিক সদস্য ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিল বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অটল থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে জেএসএসের তৎকালীন গেরিলা শাখা শান্তি বাহিনীর কয়েক বিদ্রোহী নেতা ইউপিডিএফ গড়ে তোলেন। চুক্তির পর শান্তি বাহিনীর এক হাজার ৯৪৭ সদস্য বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। তবে অস্ত্র জমা না দিয়ে শান্তিচুক্তি মানতে অস্বীকার করেন বিদ্রোহীরা। চুক্তির এক বছর পর ইউপিডিএফ গঠন করে নতুন করে সশস্ত্র সংগ্রামে ফিরে যান তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুরুতে পাহাড়ি জনগণকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিলেও গোপনে গড়ে তোলা হয় বিশাল গেরিলা বাহিনী। যাদের কাছে বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রয়েছে।

অন্যদিকে, ইউপিডিএফের আধিপত্যে শঙ্কিত হয়ে নতুন করে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কর্মীরা।

রত-মিয়ানমার সীমান্ত পথ দিয়ে এ সব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছেন তারা। বিবদমান ওই দলগুলোর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের প্রায় ১৩ লাখ মানুষ।

খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় ইউপিডিএফের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে বলেন, অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়ে গেরিলা বাহিনী শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। অস্ত্রের জোগানে সহায়তার জন্য মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত টেকনাফ ও কক্সবাজারে গঠন করা হয়েছে ইউপিডিএফের দুটি নতুন শাখা। চীন থেকে পাঠানো অস্ত্রের চালান থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সিন প্রদেশ হয়ে টেকনাফ ও কক্সবাজার দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে নেওয়া হয়েছে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১২ সালের জুন-জুলাইয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের একটি চালান গ্রহণ করে ইউপিডিএফের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা। সে সময় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে ছবি তোলেন তারা। অনুসন্ধানে সেই ছবির কয়েকটি দ্য রিপোর্টের হাতে আসে। এর মধ্যে একটি ছবিতে থাকা ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী শিখা চাকমার পরিচয় পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও শিখা চাকমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে এ নিয়ে কথা হয় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রিনা দেওয়ানের সঙ্গে। গত জুনে বিয়ে করার কারণে তিনি সংগঠন থেকে অব্যাহতি নেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

ইউপিডিএফের অস্ত্র প্রশিক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন সংগঠনের দায়িত্বে থাকলেও অস্ত্রের চালান কিংবা প্রশিক্ষণের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। সংগঠনে যখন ছিলাম তখন একটা দায়িত্ব নিয়েই ছিলাম। অস্ত্র প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা থাকলে আমরাও প্রশিক্ষণ পেতাম।’

অস্ত্রসহ শিখা চাকমার ছবির বিষয়ে রিনা দেওয়ান বলেন, ‘ফটোশপের মাধ্যমে একজনের ছবিতে অন্যজনের চেহারা সংযুক্ত করা এখন কোনো কঠিন কাজ নয়। ওই ছবিতেও তেমন কিছু হওয়া অসম্ভব নয়।’

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত পথে আসা বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্রে ছেয়ে গেছে পুরো পার্বত্য অঞ্চল। পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও গোপনে গড়ে তোলা হয়েছে অস্ত্রের মজুদ। সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় অবাধে মিয়ানমারের নাগরিক ও অস্ত্র-গোলাবারুদ প্রবেশ করছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উপজাতিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে মিশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৬৫ কিলোমিটার সীমান্তে বিজিবি ক্যাম্প না থাকায় দুর্গম এ অঞ্চলে পাহাড়ি ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। আর এ সব আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন উপজাতি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি গেরিলা বাহিনী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের গ্রুপগুলোর কাছে যাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রের দাবি।

এদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে ধীরগতির অভিযোগ এনে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছে জনসংহতি সমিতি। সংগঠনটির বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে চলছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। একদিকে ইউপিডিএফ, অন্যদিকে জেএসএসের নানা উপদল একে-অপরকে ঘায়েল করতে গড়ে তুলছে অস্ত্রের মজুদ। অস্ত্র সংগ্রহে ইউপিডিএফের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে জনসংহতি সমিতি (সংস্কার গ্রুপ)। এ সংগঠনের নেতা সুদর্শন চাকমার একটি সশস্ত্র ছবিও দ্য রিপোর্টের হাতে এসেছে। এক সময় শান্তি বাহিনীর এই গেরিলা শান্তিচুক্তির পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নামেন। তিনি ২০০৯ সালে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সশস্ত্র ছবি সম্পর্কে জানতে সুদর্শন চাকমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জনসংহতি সমিতির (সংস্কার গ্রুপ) সভাপতি সুধাসিন্দু খীসা বলেন, ‘বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে কিন্তু আমাদেরকেও বাঙালি বানানোর চেষ্টা করছেন কেন? এতে আপনাদের লাভ কী? আমাদেরও বাঙালি বানালে দেশ কী অনেক উন্নত হয়ে যাবে? এভাবে বেশি বেশি বাঙালি বাঙালি করে পাহাড়ের পরিস্থিতি খারাপ করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে আমাদের অমঙ্গল হবে কিন্তু এতে সারাদেশের মঙ্গল হবে না।’

ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নিবারণ চাকমা পাবর্ত্য অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকার ও সন্তু লারমাকে দায়ী করে বলেন, ‘তারা পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সম্মান না জানিয়ে উল্টো হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এ পর্যন্ত আমাদের ২৬৪ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। পাহাড়ে সেনাশাসন অব্যাহত রেখে আমাদের নির্মূলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে কখনই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।’

সশস্ত্র অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফ নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আমরা হত্যা-সন্ত্রাসে বিশ্বাসী নই। তবে কোনো আঘাত এলে তা প্রতিহত করা হবে- এটাই স্বাভাবিক। পাহাড়ের জনগণের নিরাপত্তার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমরা প্রস্তুত আছি ও থাকব।’