১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি নেতৃত্বের সাথে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল তার ফলস্বরূপ এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা কাঙ্ক্ষিত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়নের করেছে এবং অবশিষ্ট ধারাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু ভূমিবণ্টনসহ অন্যান্য কিছু মৌলিক বিষয়ে বিভিন্ন দল ও জনগোষ্ঠীর মতামতে ভিন্নতা শান্তিচুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাসমূহ বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি করেছে।
ইতোমধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি আঞ্চলিক নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তির কারণেও চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস ছাড়াও অন্য আরও দুইটি আঞ্চলিক উপজাতি দল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটি দল ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে স্বায়ত্বশাসন দাবি করছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক অপর দল জেএসএস (সংস্কার), জেএসএস (মূল) দলের সাথে নেতৃত্বের সংঘাতে জড়িয়ে পৃথক অবস্থানে রয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে আসার কথা থাকলেও সেই অনুযায়ী আশানুরূপ শান্তি ফিরে আসেনি। আঞ্চলিক উপজাতি তিনটি দলই পৃথক পৃথক সশস্ত্র গ্রুপ পরিচালনা করে।
তিনটি দলই সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে নিয়মিত চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক উপজাতি দলসমূহের সশস্ত্র সংগঠনসমূহ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ উপজাতি-বাঙালি অধিবাসীগণ উল্লেখিত তিনটি সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজীতে অতীষ্ঠ। সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্যের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে গড়ে উঠছে না কোন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিমূলক স্থাপনা।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমানে এই অশান্ত হয়ে ওঠা, শান্তিচুক্তির পরেও সাধারণ উপজাতি, বাঙালিদের নিরাপত্তাহীনতা এসব কিছুর জন্যই কিছু কিছু উপজাতি নেতৃবৃন্দের স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিগত ক্ষমতা গ্রহণের লিপ্সাই দায়ী।
ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আঞ্চলিক উপজাতি দলসমূহের নেতৃত্বে সব সময় চাকমা সম্প্রদায়ই সুদৃঢ় অবস্থানে ছিল এবং বর্তমানেও আছে। বর্তমানে অশান্ত এই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আঞ্চলিক দল এবং এর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে মূলত চাকমারাই আছে।
একই সাথে আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, শান্তিচুক্তির ফলে গড়ে ওঠা সংস্থাসমূহ যেমন- আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ইত্যাদিতে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। একই সাথে বিদেশি সংস্থাসমূহের শীর্ষস্থানীয় পদসমূহে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ দায়িত্ব প্রাপ্ত রয়েছে।
তাই সার্বিকভাবে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধানত ১৩ থেকে ১৪টি উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও সর্বক্ষেত্রেই চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গই নেতৃত্বের অবস্থানে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব কতটুকু সাধারণ উপজাতিদের কল্যাণে কাজ করছে এবং চাকমা ব্যতিত অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিবাসীবৃন্দই বা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে।
পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ এবং চাকমা সম্প্রদায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাকমা নেতৃত্বের মধ্যে এক প্রকার স্বার্থপরতা, ক্ষমতার প্রতি লোভ এবং যেকোন প্রকারে শীর্ষস্থান দখলের প্রবণতা কাজ করেছে। চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সবসময় ‚নিজ এবং ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের জমিদারদের মধ্যে স্বীকৃত প্রথম জমিদার কালিন্দি রায়ের সিপাহী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, ইংরেজদের তুষ্ট করার প্রবণতা, ইংরেজ কর্তৃক দেশ বিভাগের সময় সকল উপজাতি সম্প্রদায়ের ভারতের সাথে সংযুক্তির ইচ্ছে থাকলেও নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নলিনাক্ষ রায়ের পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তিতে স্বস্তি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তানকে সমর্থন ও সহযোগিতা, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এম এন লারমা কর্তৃক সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন শান্তিবাহিনী গঠন, দেবাশীষ রায়ের দেশবিরোধী প্রচারণার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্বার্থন্বেষী মহলের সহায়তায় নতুন উদ্ভাবিত ‘আদিবাসী’ দাবি ইত্যাদি, এসব কিছুই চাকমা সম্প্রদায়ের কোন কোন গোত্রের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফুটে ওঠে।