পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ চাকমাই আরাকান
অঞ্চল থেকে শরণার্থী হিসেবে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে এসেছিল। চাকমাদের তথাকথিত রাজবংশের
শুরুটা ছিল কালিন্দি রায়ের মৃত্যুর পর থেকে। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কালিন্দি রায় ও ধরম
বক্স খাঁ’র কন্যা মেনকা এবং তার স্বামী গোপীনাথ দেওয়ান চাকমার সন্তান হরিশ্চন্দ্র
রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের জমিদারির দায়িত্ব পাবার পর, ‘এই অঞ্চলটি চাকমাদের’ এরূপভাবে প্রচার পেতে শুরু করে।
মোঘল জমিদার ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর তার
প্রথম স্ত্রী কালিন্দি রায় (যে চাকমা সম্প্রদায় থেকে জমিদার পরিবারের বধূ হয়ে
এসেছিল) ব্রিটিশদের আনুকূল্যে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা লাভের পূর্বে চাকমাদের
জন্য পৃথক কোন জমিদারি ছিল না। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে চাকমা সম্প্রদায় আরাকানিদের নিকট
থেকে বিতাড়িত হবার পর প্রাথমিক পর্যায়ে বান্দরবানের আলীকদমে অবস্থান নেয়, তবে
চাকমাদের পূর্বে আলীকদমে মোঘলদেরও অবস্থান ছিল। বিভিন্ন সময় উত্থান পতনের পর
আলীকদম থেকে মোঘল জনগোষ্ঠীর জমিদারগণ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামের
রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থান নেয়।
আর এখানে প্রথম জামিদারি স্থাপন করে শেরমস্ত
খাঁ (১৭৩৭-১৭৫৩ খ্রি.)। এরপর যথাক্রমে রাজা শুকদেব (১৭৫৩-১৭৫৮ খ্রি.), রাজা
শের জব্বার খাঁ (১৭৫৮-১৭৬৫ খ্রি.),
রাজা
শের দৌলত খাঁ (১৭৬৫-১৭৮২ খ্রি.), রাজা জানবক্স খাঁ
(১৭৮২-১৮০০ খ্রি.), রাজা তব্বার খাঁ
(১৮০০-১৮০১ খ্রি.), রাজা জব্বর খাঁ (১৮০১-১৮১২
খ্রি.), রাজা ধরম বক্স খাঁ (১৮১২-১৮৩২ খ্রি.) এবং কালিন্দি রায়
(১৮৪৪-১৮৭৩ খ্রি.) পর্যায়ক্রমে জমিদারি পরিচালনা করে। কিন্তু এই জমিদার পরিবারের
বিপত্তি শুরু হয় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে যখন রাজা জব্বর খাঁ তার উত্তরাধিকার হিসেবে
কোন পুত্র না থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। রাজা জব্বর খাঁর মৃত্যুর ১৮ মাস পর তার
স্ত্রীর গর্ভে পুত্র সন্তানের (ধরম বক্স খাঁ) জম্ম হলে ঐ সন্তানকে জমিদারের
উত্তরাধিকারী হিসেবে কেউ মেনে নিতে চায়নি। ব্রিটিশরা এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ
করে।
তারা জমিদার পরিবারের বিশৃংখল পরিস্থিতির
সুযোগ নিয়ে মুসলিম এবং মোঘলদের কোণঠাসা করতেই বিতর্কিত শিশু ধরম বক্স খাঁ’র পক্ষ
নেয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধরম বক্স খাঁ জমিদার হিসেবে ঐ সময় দায়িত্ব গ্রহণ করন।
কিন্তু ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বিশ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে রাজা ধরম বক্স খাঁ
মৃত্যুবরণ করায় আদালতের রায়ের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার মোঘল বংশজাত সুখলাল খাঁকে
জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। কিন্তু ধরম বক্স খাঁ’র স্ত্রী কালিন্দি রায়
(চাকমা সম্প্রদায়ের মেয়ে, ধরম বক্স খাঁ’র স্ত্রী)
বিষয়টি আদালতে আপিল করলে দীর্ঘ ১২ বছর পর ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার অনুকূলে রায় পায়।
তারপর থেকে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালিন্দি রায় জমিদারী পরিচালনা করে মৃত্যুবরণ
করে। কালিন্দি রায়ের মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র হরিশ্চন্দ্র জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ
করে। বর্তমান চাকমা সম্প্রদায়ের তথাকথিত রাজাদের রাজত্ব হরিশ্চন্দ্র থেকেই শুরু
হয়েছিল।
এখানে আরো একটি বিয়য় বলে রাখা ভালো। ১৮৫৭
সালে হরিশ্চন্দ্র তৎকালীন জমিদার কালিন্দির নির্দেশে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ
সরকারকে সহায়তা করার উপহার স্বরূপ রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করেছিল। পরবর্তীতে
হরিশ্চন্দ্র জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর থেকে তার জমিদারী
রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করে। রাঙ্গামাটিতে চাকমাদের জমিদারি স্থানান্তরের পর যথাক্রমে
হরিশ্চন্দ্র রায় (১৮৭৩-১৮৮৫ খ্রি.),
ভুবন
মোহন রায় (১৮৮৬-১৯৩৩ খ্রি.), রাজা নলিনাক্ষ রায়
(১৯৩৪-১৯৫১ খ্রি.), রাজা ত্রিদিব রায়
(১৯৫২-১৯৭১ খ্রি.), রাজা কুমার সুমিত রায়
(১৯৭২-১৯৭৭ খ্রি.) এবং রাজা দেবাশীষ রায় (১৯৭৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত) চাকমা
সম্প্রদায়ের রাজা হিসাবে কর্তব্য পালন করছে।