শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা ছিল রাজাকার

শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা ছিল রাজাকার
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের পরিক্রমা পরিবর্তনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে এমএন লারমা একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ।
এমএন লারমা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ পূনর্গঠনে ব্যস্ত তৎকালীন সরকারকে তাদের দাবি দাওয়া সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট সময় না দিয়ে, সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক পথ অর্থাৎ সশস্ত্র দল গঠন করে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ও সাধারণ জনগনের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের সূচনা করেছিল ।
তার জন্ম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে রাঙ্গামাটি’র চাকমা উপজাতির একটি পরিবারে । ১৯৫৬ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে । পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৩ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাশ করে। ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে থেকে বিএড ডিগ্রী অর্জন করে ।
পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করে এবং চট্টগ্রাম জেলা বার এর একজন সদস্য আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে।

৯৫৬ সালে “জুমিয়া স্টুডেন্ট মুভমেন্ট” গঠনে ভূমিকা রাখে এবং পরবর্তিতে ১৯৬২ সালে পার্বত্য অঞ্চলের যুবকদের নিয়ে একটি সংগঠন “পাহাড়ি ছাত্র সমিতি” গঠন করে ।
তাকে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে গ্রেফতার করে ।
পরবর্তীতে দুই বছর পর ৮ মার্চ ১৯৬৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে উপজাতিদের অধিকার সমুন্নত রাখার আন্দোলনে রাজনৈতিকভাবে তার অনুসারীদের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়কে একত্রিত করতে সচেষ্ট হয়।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চাকমা সম্প্রদায়ের বিতর্কিত ভূমিকা সর্বজনবিদিত । তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল । সে চাকমা সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সে প্রেক্ষিতে এমএন লারমা চাকমা জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকমা এলাকাগুলোতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হতে থাকে । পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারীতে মুক্তিযোদ্ধাগণ সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন । দেশে ফেরার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে একযোগে কাজ করা শুরু করেন । পুরো জাতি যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনগঠনে ব্যস্ত তখন এমএন লারমা ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সালে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” দল গঠন করে ।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এই পরিক্রমায় হঠাৎ করেই এমএন লারমা ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একটি সশস্ত্র শাখা “শান্তিবাহিনী” গঠন করে । বিষয়টি নিয়ে একটি জনশ্রুতি ছিল যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত পিস কমিটির কমিটির চিন্তাধারা থেকেই এর বাংলা প্রতিশব্দ “শান্তিবাহিনী” নামটির উৎপত্তি হতে পারে ।

এমএন লারমা গোপনে “শান্তিবাহিনীর” সশস্ত্র দলের প্রস্তুতির পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিও চালিয়ে যাচ্ছিল । ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।

১০ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে সীমান্তের ওপারে ইমারা গ্রামের বাঘমারা নামক স্থানে শান্তিবাহিনীর কল্যাণপুর ক্যাম্পে প্রীতি গ্রুপের সদস্যদের হামলায় এমএন লারমা নিহত হয় ।
কল্যাণপুর ক্যাম্পের অপারেশন এর ঘটনা সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, প্রীতি গ্রুপের ক্যাপ্টেন এলিন এর নেতৃত্বে ৮-১০ জনের একটি সশস্ত্র দল লারমা গ্রুপের ক্যাম্পে অতর্কিত সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে উক্ত ঘটনা ঘটায় । ঐ সময়কার ঘটনাবলী সম্পর্কে আরও জানা যায়, একই দিনে মতিবান পুলিশ ক্যাম্প হতে ১ মাইল পূর্বে প্রীতি গ্রুপ এমএন লারমার মামার বাড়িতে অবস্থানরত শান্তিবাহিনীর সদস্যদের উপরও আক্রমণ চালায়, যদিও এ আক্রমণে কেউ হতাহত হয়নি ।
এমএন লারমা হত্যাকাণ্ডে পর তার অনুজ সন্তু লারমা জন সংহতি সমিতির দায়িত্বভার গ্রহণ করে । তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আজ অবধি কোথাও কোন মামলা হয়নি অথবা লারমা গ্রুপ থেকেও উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি । এমএন লারমাকে হত্যা করার বিষয়টির সত্যতা থাকার পরও এ বিষয়ে কোন আন্দোলন অথবা প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেনি ।
অন্যদিকে কল্পনা চাকমার বিষয়টির প্রচারিত গল্পের কোন সত্যতা বা ভিত্তি না থাকলেও বিষয়টিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবস ও বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে যা উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর স্ববিরোধী ভূমিকারই বহিঃপ্রকাশ ।

এমএন লারমার জীবনের সার্বিক বিষয় মূল্যায়নে বলা যায় সে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব যিনি দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে, যার প্রতিফল হিসাবে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশকে চরমভাবে মূল্য দিতে হয়েছে এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ।