শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলের আমবাতেন্না শত শত বৌদ্ধ লাঠি-সোটা, পাথর ও পেট্রল বোমা হাতে আমবাতেন্নার আনাচে-কানাচে মুসলিমদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে।
বৌদ্ধদের নেতৃত্ব দিচ্ছে সন্ন্যাসী বোদু বালা সেনা। বৌদ্ধ এ সন্ন্যাসীর সঙ্গে মিয়ানমারের কট্টরপন্থী উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক রয়েছে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে মূলত ভূমিকা রাখছে বিবিএস নামে একটি উ
গ্র ধর্মীয় সংগঠন। বিবিএস এর পূর্নরূপ বদু বালা সেনা। এর কার্যক্রম অনেকটা ভারতের শিবসেনা বা আরএসএস এর মত। বিগত কয়েক বছর যাবত শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ চরমপন্থিরা বেশ অদ্ভুত দাবি করে আসছিলো। তাদের দাবি, রেস্তোরাগুলোতে খাবারের সাথে জন্মনিরোধক ট্যাবলেট মেশানো হচ্ছে। এর ফলে সিংহলা নারী ও পুরুষেরা সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারাচ্ছে। মুসলিমরা দ্বীপে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এ কাজ করছে বলে তারা দাবি করে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, মুখে জন্ম নিরোধক বড়ি খেয়ে কেউ বন্ধ্যা হয়ে যাবে, এমন অদ্ভুত দাবি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। পরিকল্পিতভাবেই ২০১২ সাল থেকে নানান তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত করেছে বিবিএস।
শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ। যার ৭০ শতাংশ হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। মোট জনগোষ্ঠীর ১৩ শতাংশ হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যার অধিকাংশই তামিল। আর ৯ শতাংশ মুসলমান। বছর কতেক যাবত সেদেশে মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
শ্রীলংকায় মুসলিমদের পশু জবাই করার রীতিও এখন বিভেদের ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বদু বালা সেনার নেতৃত্বে ‘বৌদ্ধ ব্রিগেড’ সেই দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে র্যালির আয়োজন করে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে বৌদ্ধভিক্ষুরাই। তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিচ্ছে এবং মুসলিমদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বর্জনের আহ্বানও জানাচ্ছে।
অহিংসানীতি বৌদ্ধ শিক্ষার মূল বিষয় হলেও শ্রীলঙ্কায় অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাতে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের অসহিষ্ণুতা ক্রমেই উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে। কলম্বোর শহরতলির ছোট্ট একটি মঠ বা বৌদ্ধ মন্দির। সাদা ও বেগুনি রঙের পদ্ম ফুল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে বুদ্ধের একটি ছবি। দেয়ালে সারি সারি বুদ্ধের ছবি টাঙানো। এই মন্দিরটিই কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন বিএসএস’র প্রধান কার্যালয়। সিংহলি ভাষায় সংগঠনটির নাম বদু বালা সেনা, ইংরেজিতে বুদ্ধিস্ট পাওয়ার ফোর্স।
গালাগো আত্তে নানাসেরা এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। মুসলমানেরা সিংহলি, তাদের শেকড়ও সিহংলিদের মতোই কয়েক শ’বছরের। বৌদ্ধ ধর্মের এই চরম অসহিষ্ণু মনোভাব শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন নয়।
তামিল জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলা সহিংস বিদ্রোহী গ্রুপ তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের ফলে বৌদ্ধ কট্টরপন্থী ধারণা ফের জাগ্রত হয়। এই লড়াইকে সিংহলি ও বৌদ্ধ ধর্মকে প্রতিরোধের লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করে ২০০৪ সালে নয়জন ভিক্ষু জাতীয়তাবাদী দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। সে সময় এটিই ছিল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মূল দল, পরে গালাগো আত্তে নানাসেরা সেটি ভেঙে বর্তমান দল বদু বালা সেনা (বিবিএস) গঠন করে। একই ধরনের আদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এটি বর্তমানে এ ধারার মূল সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১২ সাল থেকে বিবিএস অন্যান্য সমজাতীয় সংগঠনের মতো সরাসরি হামলা-সহিংসতায় লিপ্ত হয়। তারা মুসলমানদের কসাইখানায় হামলা চালায়। তারা অভিযোগ করে যে, মুসলমানেরা পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করছে। এর সদস্যরা আরেকবার মুসলমানদের পক্ষে পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করার মিথ্যা অভিযোগে একটি আইন কলেজের সামনে বিক্ষোভ করে। যুদ্ধে তামিলরা পরাজিত হওয়ার পর মুসলমানেরা এখন এই বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
২০১৫ সালে ভিজ্জিথা মুসলমান সম্প্রদাযের অভিযোগগুলো তুলে ধরার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। বিবিএস সেই সম্মেলনে হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেয়। গালাগো আত্তে নানাসেরা তাকে অপমান ও হুমকি দিয়ে বলে, ‘তুমি যদি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের সাথে জড়িত হও, তোমাকে তুলে নিয়ে মাহাওয়েলি নদীতে ছুড়ে ফেলা হবে।’
বদু বালা সেনা (বিবিএস) ২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর বলেছে,তারা একটা জোট গড়ে তুলতে ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে।কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংঘের মতে,‘এই অঞ্চলে ইসলামী চরমপন্থীদের উত্থান’-এর বিরুদ্ধে,তাদেরকে দমনের লক্ষ্যেই আরএসএস’র সঙ্গে জোট গড়তে চাচ্ছে বিবিএস।(এএফপি)