সম্প্রতি রাঙামাটি অঞ্চলের সার্কেল চিফ বা কথিত রাজা দেবাশীষ রায় পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে তার বিভিন্ন অপতৎপরতার কারণে আলোচনায় আসলেও একজন আত্মস্বীকৃত কুখ্যাত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্র হয়েও রাঙামাটি অঞ্চলের সার্কেল চিফ হওয়া নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক অনেক পুরনো।
দেবাশীষ রায়ের বাবা প্রয়াত ত্রিদিব রায় রাঙামাটি সার্কেলের ৫০তম চাকমা রাজা ও সার্কেল চিফ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়- সে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী একজন আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধু প্রবল বিরোধিতাই নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ায় সে রাগে, ক্ষোভে ও ভয়ে রাজ্য ও রাজত্ব ছেড়ে পালিয়ে তার প্রিয় পাকিস্তানে চলে যায়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রও তাকে অবমূল্যায়ন করেননি। আমৃত্যু দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর মর্যাদা দান করেছিল তাকে। এজন্য তাকে বলা হতো পাকিস্তানের উজিরে খামাখা! ৪২ বছর ইসলামাবাদেই ছিল তিনি। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানেই মারা যায় রাজা ত্রিদিব রায়।
দেবাশীষ রায়ের বাবা প্রয়াত রাজা ত্রিদিব রায়ের আমলনামা ঘেঁটে জানা যায়, পাকিস্তান প্রেমের কারণে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার বিরোধিতা করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দেয়। ১৯৭০- এর দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্ত্রিসভায় সেমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। পরে সে পাকিস্তান সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলে। ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আহ্বান জানালেও পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রপতি হতে না পারার কারণে ত্রিদিব রায় তা গ্রহণ করতে পারেনি।
প্রিয়জিৎ দেব সরকারের লেখা ‘দ্য লাস্ট রাজা অব ওয়েস্ট পাকিস্তান’ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। যুদ্ধ শুরুর পর মে মাসে সে রিজার্ভ বাজার এবং তবলছড়ি বাজারে জনসভায় ভাষণ দেয়। এসব জনসভায় সে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের দামামার মধ্যেও পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র চষে বেড়ায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ত্রিদিব রায় আর বাংলাদেশে আসেনি। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের যোগদানের আবেদনের বিরোধিতা করার জন্য পাকিস্তান প্রেরিত প্রতিনিধি দলেও ত্রিদিব রায় প্রধান ছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রণীত দালাল আইনে তার নাম ছিল।
১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ত্রিদিব রায় বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিল। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করার পর সে চূড়ান্তভাবে পাকিস্তান ফিরে আসে। এরপর থেকে সে সেদেশের এম্বাসেডর এট লার্জ ছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে পাকিস্তান বুড্ডিস্ট সোসাইটির প্রধানের দায়িত্বে ছিল।
২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুর পর ওই লাশ ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে পাকিস্তান। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি যুদ্ধাপরাধী ও আজীবন পাকিস্তানের মন্ত্রী ত্রিদিব রায়ের মরদেহ।
২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের এক আদেশে ৯০ দিনের মধ্যে সব স্থাপনা থেকে তার নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় কোনো রাজাকারের নামে বাংলাদেশে কোনো স্থাপনা না থাকার বিধান রয়েছে। এরপর থেকে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে দেবাশীষ রায়ের বাবা আত্মস্বীকৃত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের নাম। উঠে এসেছে একাত্তরে তার জঘন্য ভূমিকার নানা ইতিহাসও।
আজ সে রাজাকার ত্রিদিবেরই সন্তান দেবাষিশ পার্বত্য চট্রগ্রামের রাজা সেজেছে। তার পিতার অনুসরণে সেও বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পার্বত্য চট্রগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে জুম্মল্যান্ড রাষ্ট্র গঠন করার জন্য সে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে আঁতাত করছে।
সরকারের উচিত এই দেশদ্রোহী রাজাকার সন্তানের সকল ক্ষমতা বাতিল করে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া।