রানী কালিন্দির বৃটিশ প্রেম এবং রাজাকার ত্রিদিভ রায়

রানী কালিন্দির বৃটিশ প্রেম এবং রাজাকার ত্রিদিভ রায়


জমিদারী মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকে জমিদারীতে ইংরেজ এবং প্রভাবশালী হিন্দুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও, ভারতবর্ষ জুড়েই মোগলরা ইংরেজদের চক্ষুশূলে পরিণত হওয়ায় এখানেও তার প্রভাব পড়ে। দূরদর্শী রাণী কালিন্দী দেবীও এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল বিধায়  ইংরেজদের সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী এই জমিদারীর প্রকৃত ন্যায়সঙ্গত দাবীদার মোগলদের বঞ্চিত এবং নির্মূল করে নিজের ক্ষমতাকে জোরকদমে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। 
আর বিনিময়ে ইংরেজদেরকে খুশি করার ক্ষেত্রেও রাণীকে নানা কৌশল এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিলো। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় পদক্ষেপ ছিলো, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। রাণী কালিন্দী তখন ব্রিটিশদের মনোতোষণের জন্যই স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক সিপাহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে এবং তাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। মোহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহ তাঁর ‘আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম,’ ১৯৬৭, (পৃষ্ঠা-১০৩)-এ লিখেছেন, রাণী কালিন্দী দেবীর পূর্বে প্রত্যক্ষভাবে চাকমাদের সাথে ব্রিটিশ কোম্পানির তেমন কোন বিশেষ সম্পর্ক ছিলো না। কৌশলী ও সুচতুর রাণী কালিন্দী দেবী আনুগত্য লাভে ব্রিটিশ সরকারকে বিশেষভাবে সহযোগিতা প্রদান করে। এমনকি চট্টগ্রামে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহকালে বিদ্রোহী সৈনিকরা পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করলে, রাণী কালিন্দী তাদেরকে ধৃত করার জন্য সরকারকে সহযোগিতা করেছিলে। 
সিপাহী বিদ্রোহের পলাতক সৈনিকদের বিরুদ্ধে এমন দায়িত্ব পালনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে রাণী কালিন্দী দেবীকে বার্ষিক ১১৪৩ টাকা কর্ণফুলী নদীর বার্ষিক জলকর মওকুফ করে দেয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ে কিছু উপজাতীয় নেতা রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিরোধিতায় তৎকালীন চাকমা রাজা সরাসরি নেতৃত্ব না দিলেও অনেকে ধারণা করেন, এতে রাজপরিবারের ইন্ধন ছিলো। 
তারপর, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় নিজেই রাজাকার বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদারদের পরাজয় ঘনিয়ে এলে ত্রিদিব রায় তার পরিণতি আন্দাজ করতে পেরে নভেম্বর মাসে মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। ত্রিদিব রায় কোনদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করত না আর  পাকিস্তানেই বসবাস করত এবং ২০১৩ সালে পাকিস্তানেই মারা যায়।  
ত্রিদিব রায় রাজাকার ছিলেন বিধায় তার লাশও বাংলাদেশে আনতে দেয়া হয়নি। মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে ত্রিদিব রায় তার প্রকাশিত বিতর্কিত গ্রন্থ , ‘The Departed Melody’-তে লিখেছে, ‘১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল সকালে   ত্রিদিব রায় তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে। পাকিস্তানীদের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙ্গামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়!’
গ্রন্থণা ও সম্পাদনাঃ অভিলাষ খান
ধানমন্ডি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
তথ্যসূত্রঃ
০১. পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস-মোঃ জামাল উদ্দিন এবং
০২. চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার -অশোক কুমার দেওয়ান।
আলোকচিত্রঃ চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায়