লকডাউনের পক্ষে আর হার্ড ইম্যুনিটির বিরুদ্ধে লোকদের আজগুবি হিসেব নিকেষ প্রায় মিডিয়াতে দেখি, যা বাস্তবতার সাথে মিলে না। যেমন-
"যদি লকডাউন খোলা হয় বা হার্ড ইম্যুনিটির দিকে যাওয়া হয়, তবে দেশের ৮০% লোককে আক্রান্ত হতে হবে। ১৬ কোটি লোকের মধ্যে ৮০% মানে ১২.৮ কোটি এবং এর মধ্যে যদি ২০% লোককে যদি হাসপাতালে যেতে হয়, যার পরিমাণ আড়াই কোটি, আর ১% লোকও যদি মারা যায়, তবে ১২ লক্ষকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আড়াই কোটি লোককে চিকিৎসা দেয়ার ক্ষমতা কি আমাদের আছে ? আর মৃত্যুর হিসেবটা একবার চিন্তা করেছেন ১২ লক্ষ।"
এই যে সুন্দর ক্যালকুলেটরে হিসেব-নিকেষ, আপনি যদি এই সংখ্যা দিয়ে মানুষকে ভয় দেখাতে চান, তবে অন্য কথা। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু এই হিসেব মানে না।
প্রথমেই বলি- এই হিসেবে কিন্তু দুইটি জিনিসকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে-
১) পুরো দেশকে একত্র হিসেবে চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি এমন ঘটে না। কারণ ভাইরাস দেশের সীমানা বুঝে না। বরং একটা করে পাড়া-মহল্লা বা কমিউনিটি হিসেবে চিন্তা করে ঘটনাগুলো ঘটে। ধরে নিতে পারি বাংলাদেশে ৮৫ হাজার গ্রাম আছে। এবং গড়ে ৫ টি মহল্লা-পাড়া নিয়ে একটি গ্রাম। তাহলে আমাদের চিন্তা করতে হবে প্রায় ৪ লক্ষ মহল্লা বা কমিউনিটিকে নিয়ে।
২) সময়। কত সময় লাগবে, সেটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
যেভাবে আমাদের বুঝানো হচ্ছে যে, করোনা ভাইরাসের ছড়ানোর গতি অনেক বেশি, কিন্তু বাস্তবে সেরকম পাওয়া যাচ্ছে না। গড় একটি হিসেব করে দেখা গেছে করোনা ভাইরাসের ট্রান্সমিশন রেট গড়ে ২ থেকে ৩ জন। ঠাণ্ডার আবহাওয়ার সুইডেনের স্টকহোমে, যেখানে লকডাউন-সোশ্যাল ডিসটেন্স কিংবা মাস্ক-হ্যান্ড গ্লাবস কিছুই ব্যবহার হয়নি, সেখানে করোনার প্রথম কেস থেকে ৮০ দিন পর বলা হচ্ছে মাত্র ১১% জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছে। (https://bit.ly/2SFE7Z4) অর্থাৎ পুরো স্টকহোমে ছড়াতে সময় লাগবে কমপক্ষে আড়াই বছর।
অর্থাৎ যেখানে করোনা ভাইরাস খুব গতি নিয়ে আঘাত করেছে সেখানেও করোনা ভাইরাসের গতি ছিলো খুব কম। আর বাংলাদেশের মত গরম দেশে করোনা ভাইরাসের ট্রান্সমিশন রেট কত হবে ? ৪ লক্ষ পাড়া বা মহল্লায় তা ছড়াতে কত সময় লাগবে ? ২ বছর নাকি ৪ বছর ??
হয়ত বলতে পারেন- এখন তো লকডাউন, মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে পারছে না, তাই করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারছে না। ফলে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব বোঝা যাচ্ছে না।
এজন্যই তো সুইডেনের স্টকহোমের উদাহরণ আনলাম।
সেটাও যদি না মানেন, তবে তাদেরকে আমি বলবো- পাইলট প্রকল্প মানে কি বুঝেন?
ধরেন কোন একটি প্রজেক্ট নেয়া হলো ৮৫ হাজার গ্রামে।
এরজন্য একটি গ্রামকে প্রথমে বেছে নেয়া হয়। সেই গ্রামের উপর টেস্ট করে তার ফলাফল দেখে সে অনুসারে সারা বাংলাদেশে তা এপ্ল্যাই করা হয়।
এজন্য যেসব এলাকায় করোনায় লকডাউন হইছে, সে রকম একটি এলাকাকে বাছাই করেন প্রথমে।
এরপর দেখেন সেখানে গত ২ মাসে ঠিক কতজন আক্রান্ত হইছে। কতজন মৃত্যুবরণ করছে?
ঐ এলাকার মৃত্যুবরণ সংখ্যা কি স্বাভাবিক মৃত্যুর থেকে বেশি না কম?
যেমন ধরেন- মুহম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, যেখানে ৫০ হাজার লোক গাদাগাদি করে থাকে। সেখানে করোনায় আক্রান্ত ধরা পড়ছে। ১ জন সরকারী হিসেবে মারাও গেছে। কিন্তু গত ৩ সপ্তাহে ঐ এলাকায় বিভিন্ন রোগে ভুগে মারা গেছে আরো ১৩ জন, যেটা নিয়ে মিডিয়ায় সন্দেহ প্রকাশ করা হইছে। এবার প্রতি বছরে হাজারে মৃত্যুহার ৫.৫ ধরে দেখেন ৩ সপ্তাহে ঐ এলাকায় হিসেব মত কতজন মারা যাওয়ার কথা ? ১৭ জনের। কিন্তু মারা গেছে ১৪ জন।
তারমানে ঐএলাকায় করোনা হানা দিয়েছে, কিন্তু গড় মৃত্যুর হিসেব কিন্তু ক্রস করেনি। তারমানে বোঝা যাচ্ছে, আজকে যদি করোনা নামক ভাইরাস নাও থাকতো, তবে ঐ এলাকায় এতগুলো লোকই মারা যেতো এবং সেটা স্বাভাবিক।
একইভাবে ঐ এলাকায় কত লোক অসুস্থ হয়েছে ? কত লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, এই হিসেবগুলো করলেই সহজে বের হয়ে যাবে, আসলে ১টা মহল্লায় যদি এমন হয়, তাহলে বাকি মহল্লাগুলোতে কি হবে।
আসলে এই ভাইরাসগুলো বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করার পর বিভিন্ন ফ্যাক্টরের সম্মুক্ষিন হয়। পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট হার্ড ইম্যুনিটির বাধন, সব মিলিয়ে ১৬ কোটি লোকের অধিকাংশের মধ্যে নাও পৌছাতে পারে। আর যতটুকু পৌছায় সেটা সময় নিয়ে পৌছায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন সময় আমরা মানুষ অসুস্থ হওয়ার খবর শুনি, চিকিৎসা সেবা নেয়ার কথা শুনি, মানুষের মৃত্যুর খবর শুনি, এই ভাইরাস আক্রমনটাও স্বাভাবিকতারই অংশ। সেই স্বাভাবিক অংশ হিসেবেই মানুষ অসুস্থ হবে, হাসপাতালে যাবে কিংবা মারা যাবে। এবং সেটা হবে সময় নিয়ে। আপনি ২ মাস দেশ বন্ধ করে রাখলেও কোন লাভ হবে না। কারণ ভাইরাস তার গতিতেই ছড়াবে। এজন্য একাধিক বছরও সময় লাগতে পারে। ২ বছর নিশ্চয় সব বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। আর যদি ২ বছর মানুষ লকডাউন করে বসেও থাকেন। তবে দিন শেষে দেখবেন, যতজন লোক মারা যাওয়া, সময় নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া, অসুস্থ হওয়ার কথা, ততগুলো লোকই হয়েছে। ফলে হাসপাতালের উপর স্বাভাবিক যতটুকু চাপ পড়ার ততটুকুই পড়েছে, বেশি পড়েনি।
অর্থাৎ পুরো ঘটনা ঘটেছে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, সময় নিয়ে। মাঝখান দিয়ে সব বন্ধ করে আপনি বোকার মত ঘরে বসে আছেন।