d
করোনা ভাইরাসের সাথে বৈষম্য শব্দটির একটি গভীর মিল পাচ্ছি।
ইউরোপ আমেরিকায় করোনায় বিশাল মৃত্যুর একটা বড় অংশ হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে।
ওদের দেশে তরুণরা বৃদ্ধদের প্রতি বৈষম্য করে। ঘরে রাখতে চায় না, বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে।
ইউরোপে করোনা হানা দেয়ার পর সেখানে অনেক বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বরতরা পালিয়ে যায়,
পরে উদ্ধারকর্মীরা সেখানে দিয়ে বহু লাশ পায়।
এই যে বৃ্দধরা সেখানে এত মারা গেলো, তারা যদি একটু দেখাশোনা পেতো,
তবে কি তাদের মৃত্যুর এত হতো ?
আমেরিকায় করোনার মৃত্যুর পর হিসেব মিলিয়ে দেখা গেছে,
মৃত্যুর একটা বড় অংশ কালোদের, সাদাদের মধ্যে না।
সেখান থেকে একটা প্রশ্ন এসেছে, হাসপাতালগুলোতে যে চিকিৎসা হয়েছে,
সেখানে কি কালোরা ঠিক মত ট্রিটমেন্ট পেয়েছে ?
যদি ঠিকমত ট্রিটমেন্ট পেতো, তবে কালোদের মৃত্যুহার এত বেশি হলো কেন ?
কালোদের মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে কি করোনা দায়ী নাকি কালোদের প্রতি বিদ্বেষ/অবহেলা দায়ী ??
এবার আসি করোনার জন্য লকডাউন-কোরেন্টাইন নিয়ে।
করোরেন্টাইন হলো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র সমষ্টি অর্থে, আর লকডাউন হইলো ব্যাপক অর্থে সবাইকে আটকে রাখা। আজ থেকে শত বছর আগে শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র কোরেন্টাইন নিয়ে লিখেছিলো। তার ভাষায়-
“পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।”
শরৎচন্দ্র বলেছিলো- কোয়রান্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হয় মূলত ‘ছোটলোকদের’।
অর্থাৎ ১০০ বছর আগেও গরীবদের কোয়ারেন্টিনের নামে আটকে রাখা হতো।
বর্তমানে লকডাউনও কিন্তু দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর জন্য, বড়লোক বা এলিট ক্লাসের চাপিয়ে দেয়া বৈষম্য।
বড়লোকদের বাড়ি খাবার মজুদ আছে, ব্যাংকে জমানো আছে টাকা, সরকারী চাকুরীজীবীদের মাস শেষে ফিক্সড বেতনও আছে। প্রাইভেট গাড়ী আছে। দারোয়ান বাজার করে দিচ্ছে, আর বুয়া রান্না করে সাজিয়ে রাখছে। আর তারা স্ব-পরিবারে মুরগীর রান চিবোতে চিবোতে বলছে-
"ইস ! লকডাউন আরো শক্ত করে না কেন ? কারফিউ দিক !
ছোটলোকের বাচ্চারা রাস্তায় কি করে ?
গণ পরিবহন বন্ধ থাকলে সমস্যা কি ?
আর ১৫টা দিন বন্ধ থাকলেই কি সবাই না খেয়ে মারা যাবে ?
আর ১৫টা দিন ঠিকমত লকডাউনে থাকলে কি হয় ??"
কথা হচ্ছে, ১৫ করে, ১৫ করে ২ মাস চলে গেলেও তাদের ১৫ কিন্তু শেষ হয় না,
খালি বাড়তেই থাকে।
কারণ ধনীদের মাঝে মৃত্যুভয় কাজ করে, সেখান থেকেই তারা ১৫ দিন করে বাড়াতে বলে।
কিন্তু তাদের পেটের ভয় নেই।
একদিন না খেয়ে থাকলে পেট কিভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়, সেটা গরীবরা ভালো করে জানে। একমাসের বেতন বন্ধ থাকলে বাড়িভাড়া, গ্যাস পানি বিদ্যুৎবিলের কষ্ট মধ্যবিত্তরা জানে। গণ পরিবহনের কষ্ট তো দরিদ্র-মধ্যবিত্তরা বুঝে, যাদের প্রাইভেট গাড়ি আছে তারা তো সেটা বুঝবে না।
আসলে বড়লোকদের যদি এতই মৃত্যুভয় কাজ করে,
তবে তারা সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে যাক। সমস্যা তো নেই।
তারা কেন লকডাউনের নামে সবাইকে আটকে বন্দি রাখতে চাইছে ?
সবাইকে বন্দি করে রাখার অধিকার তো তাদের নেই।
আরেকজনকে আটকে রেখে তাকে ক্ষুধার যন্ত্রনায় কষ্ট দেয়া বা হত্যা করা তো নিকৃষ্ট অমানবিকতা।
আসলে আমরা নিজেদের আধুনিক বলে দাবী করি,
মুখে বৈষম্যমুক্ত পৃথিবীর কথা আওড়াই।
কিন্তু বাস্তবে আমরা বৈষম্যটাই প্রতিষ্টা করতে চাই।
মহামারীর নামে বৈষম্য করার যে ইতিহাস ১০০ বছর আগে লিখিত হয়েছে,
বাস্তবে তো সেটা এখনও চলছে। বাংলাদেশে বা আমেরিকায়, থেমে নেই কোথাও।