অনেকে দেখলাম কাচা চামড়া রফতানির ব্যাপারে অতি আগ্রহী,। এন.সি- ২১৬

অনেকে দেখলাম কাচা চামড়া রফতানির ব্যাপারে অতি আগ্রহী,
Related image
অনেকে দেখলাম কাচা চামড়া রফতানির ব্যাপারে অতি আগ্রহী,
আবার কেউ কেউ বলছে- “যে বেশী দাম দেবে সেই কাচা চামড়া নিবে,
সেটা দেশী হোক আর বিদেশী হোক।”
আমি জানি না, কে কতটুকু বুঝতেছে,
কিন্তু কোন কিছুর কাচামাল বা ‘র’ ম্যাটেরিয়াল রফতানি করা আসলে দেশের জন্য ক্ষতিকর।
সহজ উদাহরণ দেই, যেমন ধরুন- গম।
গমের কেজি ৩০ টাকা। সেই গম ভাঙ্গায় আপনি আটা বানালেন।
এরপর সেই আটা দিয়ে রুটি বানালেন ২০ পিস। প্রতি পিস বিক্রি করলেন ৫ টাকায়।
তাহলে ৩০ টাকার গম হয়ে গেলো ১০০ টাকায়।
অথবা সেই টাকা দিয়ে পাউরুটি বানালেন ১৫০ টাকার।
সেই পাউরুটি দিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে বিক্রি করলেন ১০০০ টাকায়।
আপনি হয়ত ৩০ টাকার গম দেশী মার্কেটে না বিক্রি করে বিদেশী মার্কেটে ৩৫ টাকায় বিক্রি করে ৫ টাকা লাভ করতে পারতেন। কিন্তু ‘র’ ম্যাটেরিয়াল হিসেবে গম বিক্রি না করে আপনি তা থেকে দেশী মার্কেটে বিভিন্ন পণ্য যখন তৈরী করতে থাকলেন, তখন প্রতি ধাপে তার মূল্য বাড়তে থাকলো। শুধু মূল্য বৃদ্ধি নয়, বরং প্রতি ধাপে একটা করে ইন্ড্রাস্টি্র তৈরী হলো।
গম ভাঙ্গিয়ে আটা করতে এক ইন্ডাস্ট্রি
আটা থেকে রুটি বানাতে আরেক ইন্ডাস্ট্রি
অথবা আটা থেকে পাউরুটি বানাতে আরেক ইন্ডাস্ট্রি
পাউরুটি থেকে স্যান্ডউইচ বানাতে আরেক ইন্ডাস্ট্রি
এই প্রতিটি ধাপে নিযুক্ত হলো আপনার দেশের জনগণ,
তাদের চাকুরী হলো, তারা খেয়ে পড়ে সংসার নিয়ে চলতে পারলো।
শুধু তাই নয় আটা থেকে রুটি, পাউরুটি, সান্ডউইচ বানাতে আরো তার সাথে যোগ হলো-
পোল্ট্রি ডিম, তেল, সবজী (রুটি দিয়ে খাওয়ার জন্য) আরো অনেক ইন্ডাস্ট্রি।
এছাড়া এসব পণ্য বহন করতে যানবাহন যোগ হলো, সেই যানবাহন চালকের বেতন হলো,
গাড়ির তেল বিক্রি হলো, সেই তেল বিক্রি করে তেলের পাম্প মালিক লাভবান হলো।
কারখানা ভাড়া দিয়ে বাড়িওয়ালা লাভবান হলো।
ঐ বাড়িতে লোকজন যাতায়াত শুরু করলো।
এত লোকজন দেখে পাশে আরেক লোক চা-পানির টং এর দোকান দিলো।
আগত লোকজন সেই টং এর দোকান থেকে চা-পানি কিনে খেলো।
সেই টাকা দিয়ে ঐ টং দোকানদারের সংসার চললো।
বাচ্চাকে স্কুলে লেখাপড়া করালো, দেশ-জাতির উন্নতি হলো।
এ রকম আরো অনেক কিছু হবে, যা শেষ করা যাবে না।
কিন্তু ঐ গমওয়ালা যদি ভাবতো, “দূর দেশে গম বিক্রি করে কি লাভ?
গম বিদেশে বিক্রি করে দেই, তাহলে ৫ টাকা বেশি পাওয়া যাবে।”
হ্যা বিদেশে রফতানি করলে হয়ত ৫টাকা বেশি পাওয়া যেতো, এটা ঠিক।
কিন্তু ৩০ টাকার গম দেশে রাখলে ৩০ হাজার টাকার উপযোগ তথা দেশের উপকার পাওয়া সম্ভব ছিলো, কিন্তু ৫ টাকার লাভের আশায় দেশের ৩০ হাজার টাকার লাভ শেষ।
এ কারণে দেশে যদি কাচামালের ব্যবহার থাকে, তবে ঐ কাচামাল বিদেশে রফতানি করা কখনই জাতির জন্য সুখকর হবে না, বরং দেশের শিল্প ব্যবস্থা ধ্বংসের নামান্তর হবে।
সম্প্রতি ট্যানারি মালিক আর আড়ৎদারদের দ্বন্দ্বে যে চামড়ার ক্ষতি হতে দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ কিন্তু গতকাল ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন। তিনি বলেন, “তাদের সঙ্গে (আড়ৎদার) আমাদের দ্বন্দ্ব হওয়ার কিছু নেই। তিন-চার বছর আগেও আমরা আড়তদারদের সব টাকা পরিশোধ করে দিতাম। এছাড়া সারা বছর লেনদেন হতো তাদের সঙ্গে। কিন্তু গত দুই বছর ধরে আমরা তাদের ঠিকমতো টাকা দিতে পারছি না। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর হতে গিয়ে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছি। আড়তদারদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছে।’ (https://bit.ly/2KPO9SF)
টাকা না দিলে দুই ব্যবসায়ী পার্টনারের মধ্যে সম্পর্কে অবনতি ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে ট্যানারি মালিকারা টাকা দিতে পারতেছে না, তাদের সমস্যার মূল কারণও কিন্তু সরকারী সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ ট্যানারি স্থানান্তর।
এক্ষেত্রে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের কারণ হাজার কোটি টাকা হয়, তবে এই টাকা সরকারের জন্য কিছুই না। সরকার একেবারে সহজ শর্তে এই টাকা ঋণ দিয়ে দিক, যে ১০ বছরে টাকা পরিশোধ করতে হবে। বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা ইন্ডাস্ট্রি যেটার সাথে লক্ষ লক্ষ লোক জড়িত, সেটা বাচাতে সরকারের সমঝোতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু সরকার সেটা না করলো কি, উল্টো ঘোষণা দিলো- কাচা চামড়া রফতানি করার। আশ্চর্য।
এক্ষেত্রে বিএফএলএলএফইএ’র সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান মো. দিলজাহান ভূঁইয়া কিন্তু বলেছেন,
“সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ ব্যাপারে আমরা বলতে চাই, আমাদের দেশে কোরবানির সময়সহ বছরব্যাপী যে চামড়াটা সংগ্রহ করি, সেই চামড়া দিয়ে আমাদের ট্যানারিগুলোর তিন থেকে চার মাস চলে। তারপর সারা বছর আমরা যে চামড়াটা পাই, ওই চামড়া দিয়ে কোনো কোনো ট্যানারি ৫০ ভাগ চলে, আবার কোনো ট্যানারি ২০ ভাগ। শতভাগ চামড়া সংগ্রহ করে কোনো ট্যানারি চালাতে পারি না। যদি কাঁচা চামড়া এক্সপোর্টের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে আমাদের হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।” (https://bit.ly/2OZyzJn)
ট্যানারি মালিকরা শুধু শ্রমিকের কথা বলেছেন, ট্যানারি শিল্পের সাথে লবন শিল্প, কেমিক্যাল শিল্প, জুতা শিল্প এরকম আরো বহু শিল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক ট্যানারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশে আর বহু শিল্পে ধস নামবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
সত্যিই বলতে আমার কাছে এবারের চামড়া সংকটের বিষয়টিকে পুরো ঘোলাটে মনে হয়েছে।
মনে হয়েছে- চামড়া ট্যানারি স্থানাস্তরের কারণে ২ বছরে যে সংকট ঘণিভূত হয়েছে,
তার মধ্যে এ বছর ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছে একটি মহল।
এর সাথে কিছু মিডিয়া, রাজনীতিবিদ ও সরকারী কিছু কর্তাব্যক্তিকে অতি উৎসাহি মনে হয়েছে।
তারা এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে কাচা চামড়া রফতানির বাজার খুলতে বেশি আগ্রহী,
এবং অবশ্যই সেটাতে দেশী শিল্পকে পথে বসিয়ে বিদেশী কোন ট্যানারির বিশেষ স্বার্থে।
বিশেষভাবে লক্ষ্য করবেন- যে মহলটির কাছে এতদিন ‘কোরবানীর চামড়া এলাকার সন্ত্রাসীদের হক’ ছিলো, কিংবা মিডিয়ার যে গ্রুপটি এতদিন মাদ্রাসায় কোরবানীর চামড়া নিয়ে অপপ্রচার করতো, তারাই এবার চামড়া হলো গরীবের হক, এতিমদের হক, মাদ্রাসার হক বলে চিৎকার চেচামেচি করেছে।
অথচ এতদিন যখন মাদ্রাসার ছাত্রদের থেকে চামড়া ছিনিয়ে নিয়ে এলাকার মাস্তানরা মদ গাজা খেয়েছে, সেটা নিয়ে কিন্তু তারা রিপোর্ট করেনি, কিন্তু এবার তাদের গরীব হক, গরীবের হক বলে অধিক ক্রন্দন ছিলো সন্দেহজনক।
আমার কাছে মনে হয়েছে ঐ মহলটি পাবলিক সেন্টিমেন্ট টেনে সেটাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করতে চেয়েছে এবং সেটা অবশ্যই কাচা রফতানি দ্বারা খুলে দেশের ট্যানারি শিল্পকে ধ্বংস করে সীমানার ওপারে কোন ট্যানারিনগরীকে দাড় করিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করেই, যা দেশের অর্থনীতির শেষ করে দেয়ার অংশবিশেষ বটে।