গতকালকে থেকে একটি মহল বেশ প্রচার চালাচ্ছে- এরশাদ নাকি ভারতের দালাল ছিলো।
এক্ষেত্রে তারা প্রমাণ হিসেবে বলছে, ক্ষমতা দখলের আগে প্রতিটা পদক্ষেপ নিয়েই এরশাদ ভারতকে অবহিত করেছিলো।
আমি এ প্রমাণের সাথে দ্বিমত নই। তবে আমি গতকালকে একটা পোস্টে এই কথাটা পুরোটা বিস্তৃতি করেছি- “এরশাদ যে চ্যানেল মেইনটেইন করেই ক্ষমতায় আসুক, ক্ষমতায় আসার পর সম্রাজ্যবাদীদের কথা ঠিকমত শুনছিলো না। ... এজন্য আন্তর্জাতিক সব ব্লকের দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলো সব একজোট হয়ে যায় তাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য।”
আমি এ প্রমাণের সাথে দ্বিমত নই। তবে আমি গতকালকে একটা পোস্টে এই কথাটা পুরোটা বিস্তৃতি করেছি- “এরশাদ যে চ্যানেল মেইনটেইন করেই ক্ষমতায় আসুক, ক্ষমতায় আসার পর সম্রাজ্যবাদীদের কথা ঠিকমত শুনছিলো না। ... এজন্য আন্তর্জাতিক সব ব্লকের দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলো সব একজোট হয়ে যায় তাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য।”
অর্থাৎ সে ক্ষমতায় আসার আগে অনেকের সাথে লিয়াজো করে আসতে পারে, কিন্তু চেয়ার পাওয়ার পর সে সব বিদেশীদের ভুলে নিজের মত করতে থাকে, সমস্যাটা হয় সেখানেই। বিশ্বের এরকম আরো বহু ইতিহাস আছে। তুরষ্কের এরদোয়ান, মিশরের মুরসি। এরাও মার্কিন লিয়াজো করে ক্ষমতায় এসেছিলো। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর এরা বিদেশী চ্যানেলের সাথে পল্টি মারা শুরু করে। নিজস্ব সিস্টেম চালু করে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে যায় মার্কিনপন্থীরা। এরশাদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই হয়েছে, সে ক্ষমতা কারো সাথে লিয়াজো করেই নিয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর আর তাদের কথা শুনেনি।
আসুন, কিছু পয়েন্ট দেখি-
১. আজকে যারা, এরশাদকে ভারতের দালাল বলেন, তারা তো শেখ হাসিনাকেও ভারতের দালাল বলেন। তাদের এন্যালাইসিস অনুসারে শেখ হাসিনা যদি ভারতের দালাল-ই হোন, তবে সে কেন এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলো ?
২. যারা বাংলাদেশে মুখে মুখে খুব এন্টি-ইন্ডিয়াইজম প্রকাশ করে, তাদের ভাষ্য বাংলাদেশে ভারতের র’ খুব শক্তিশালী অবস্থানে আছে। এরশাদ যদি ভারতের দালালই হয়, তবে জেলে থাকা এবং পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় ভারত তাকে কেন হেল্প করলো না? তাকে কেন নতুন করে ক্ষমতায় আনলো না ?
৩. মুখের কথায় নয়, একটা মানুষের কাজই প্রমাণ করে আসলে মানুষটি কেমন। ১৪ জুলাই, ২০১৯ বিবিসির প্রচারিত খবর বলছে, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মুচকুন্দ দুবে বলছে, “এরশাদের আমলে সাঙ্ঘাতিক কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি না-হলেও বড় কোনও সঙ্কটও কিন্তু হয়নি।” তাহলে এত বছর ক্ষমতায় থেকে সে যদি ভারতের সাথে বড় কোন চূক্তি না করে, তবে সে কিভাবে ভারতের দালাল হয় ?
৪. বিবিসির খবর বলতেছে, “এরশাদের আগে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে শীতলতা তৈরি হয়েছিল, সেটা এরশাদের সময় অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।”
এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, এরশাদের আগে মার্কিন-চাইনিজ ব্লক মেইনটেইন করা শাসক রুশব্লকের ভারত ও তাদের সমর্থকদের উপর খুব ধরপাকড় চালায়। এরশাদ হয়ত তাদের মার দিয়েছিলো। এটা হয়ত রুশব্লকের ভারতের জন্য সস্তিস্বরূপ ছিলো। এখানে সেটাই বলা হয়েছে, এর বেশিকিছু না।
এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, এরশাদের আগে মার্কিন-চাইনিজ ব্লক মেইনটেইন করা শাসক রুশব্লকের ভারত ও তাদের সমর্থকদের উপর খুব ধরপাকড় চালায়। এরশাদ হয়ত তাদের মার দিয়েছিলো। এটা হয়ত রুশব্লকের ভারতের জন্য সস্তিস্বরূপ ছিলো। এখানে সেটাই বলা হয়েছে, এর বেশিকিছু না।
৫. এরশাদের কিছু কিছু কার্যক্রম ভারতীয় পলিসির সাথে যায় না। বিশেষ করে,এরশাদ সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত করে। ইন্ধিরাগান্ধী থেকে শুরু করে সব ভারতীয় শাসক বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধী। এখনও মাঝে মাঝে ভারত থেকে ডাক উঠে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তনের জন্য। এরশাদ যদি সত্যিই ভারতের দালাল হতো, তবে এ কাজটা সে কখনই করতে পারতো না।
৬. আমরা এখনও বিকেন্দ্রীকরণ বিকেন্দ্রীকরণ করে চিল্লায়, কিন্তু আজ থেকে ৩০ বছর আগে এরশাদ বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা দিয়েছে এবং সেটা করতে চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশকে অনেকগুলো প্রদেশে ভাগ করা এবং প্রত্যেক প্রদেশের আলাদা রাজধানী থাকা, এটা এরশাদের ধারণা। এটা হলে আজকে এক রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীক এত বড় ঝামেলা হতো না। এছাড়া বিচারবিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ ছিলো এরশাদের ইচ্ছা। আজকে যে আইনের শাসন বাস্তবায়িত হয় না, এর মূল কারণ কোর্টগুলোতে মামলার জট। বিচারবিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ হলে, এই সমস্যা গুলো হতো না্। ২০১৯ সালে এসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, সব উন্নয়ন ঢাকাকেন্দ্রীক হচ্ছে। এটা দেশকে শেষ করে দেয়ার নামান্তর, পুরো দেশ অর্থনৈতিকভাবে শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। অথচ এরশাদ বলেছিলো ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাচলে বাচবে দেশ’- অর্থাৎ গ্রামভিত্তিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছিলো, যা এত বছর পরে এসেও অন্যান্যরা সম্পূর্ণ বিপরীত করে যাচ্ছে।
৭. গতটার্মে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসতে এরশাদকে বিরোধী দল হিসেবে ব্যবহার করেছে দেখে, অনেকে এরশাদকে ভারতীয় দালাল ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, পুরো বিষয়টি “বন্দুক বা মামলার নল ধরে” করা হয়েছে, এই একটা ঘটনা দিয়ে পুরো এরশাদকে যাচাই করা মোটেও ঠিক হবে না।
আমরা ধারণা, আজকে যারা এরশাদকে ভারতের দালাল বলে সাব্যস্ত করতে চায়, তারা মূলত কথিত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংযুক্ত ছিলো। তখন স্বৈরাচার শব্দের মধ্যে যেমন তেজ ছিলো, এখন ভারতের দালাল শব্দযুগলের মধ্যে সেরকম তেজ আছে। তাই এরশাদকে যদি ভারতের দালাল বানানো যায়, তবে তাদের কথিত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংযুক্ত থাকা এ জামানায় কিছু ফল নিয়ে আসতে পারে। আর যদি এরশাদ বাংলাদেশপন্থী হয়ে যায়, তবে তারা উল্টো দোষী সাব্যস্ত হয়।
আমি জানি, এ স্ট্যাটাস দেয়ার পর আমাকে অনেকে জাতীয় পার্টির লোক ভাবতে পারেন, সমস্যা নাই। কিন্তু আমি সত্যটা বলে যাবো। অন্তত মানুষের সত্য ইতিহাসটা জানা উচিত। ইতিহাস হচ্ছে অ্যানালাইসিসের জন্য পিলারের মত। পিলারে যদি মিথ্যা ভিত্তি থাকে, তবে আপনার অ্যানালাইসিস কখন ঠিক হবে না। তাই সত্য ইতিহাস জানা, সবার জানা জরুরী।