বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণের পেছনে ছুটে আমাদের লাভ কতটুকু ? -৩ এন.সি ১৬৮

বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণের পেছনে ছুটে আমাদের লাভ কতটুকু ? -৩

Related imageবিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণের পেছনে ছুটে আমাদের লাভ কতটুকু ? -৩
আমাদের জাতির একটা বড় হীনমন্যতা কি জানেন ?
আমরা দেশকে খারাপ মনে করি, আর বিদেশকে ভালো মনে করি।
এটা আমাদের মজ্জাগত সমস্যা, রক্তে-মাংশে একাকার সমস্যা।
মুখে যতই বলি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, বাস্তবে আমরা কিন্তু বিদেশকেই ভালোবাসি।
বিদেশীদের সাথে নিজের তুলনা করে নিজ ও নিজের জাতিকে গালি মারতে কখন কার্পন্য করি না।
এটা শুধু সমাজের একটা লেভেলের সমস্যা না-
টপ টু বটম- পুরো সমাজ এই সমস্যায় দুষ্ট।
জনগণ ভাবে- দেশ নয় বিদেশের সাথে সম্পর্ক করতে হবে,
ব্যবসায়ীরা ভাবে- দেশ নয় বিদেশের সাথে ব্যবসা করলে লাভ বেশি হবে,
বিদেশী স্টাফ আনলে কোম্পানি বেশি লাভ করবে,
সরকারও ভাবে, দেশীর তুলনায় বিদেশে ধর্ণা দিলে বেশি লাভ হবে।
কিন্তু আদৌ বিদেশের পেছনে ঘুরে আমার লাভ কতটুকু হলো,
দেশের মধ্যে সে চেষ্টাটা করলে আমার সে পরিমাণ লাভ হতো কি না, সেটা আমরা যাচাই করি না।
সবাই চিন্তা করে- বিদেশের টাকা দেশে আনলে লাভ।
কেন ভাই, দেশের টাকা যদি বাইরে না যায়, তাহলে কি লাভ নেই ?
২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশ বিদেশ থেকে বৈধ পথে শুধু পণ্যদ্রব্য আমদানি করে ৩৭ বিলিয়ন বা ৩ লক্ষ কোটি টাকার মত।
কথা হলো, সরকার বিদেশী বিনিয়োগ/ঋণ আনতে কত পলিসি/সিস্টেম করতেছে,
তারপরও বছরে আনতেছে মাত্র ২৫ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু এই ৩ লক্ষ কোটি দেশী টাকা যেন বাইরে না যায়, সে ব্যাপারে কি কোন চেষ্টা আছে ?
সরকার ২৫ হাজার কোটি টাকা আনতে যত পরিশ্রম করছে,
তার সিকিভাগও যদি আমদানি হ্রাসের চেষ্টার জন্য করতে পারতো,
তবে একটা বড় অংশ টাকা সেভ করা সম্ভব ছিলো।
উদাহরণ বলি-
বাংলাদেশে কিন্তু কসমেটিকসের বড় মার্কেট আছে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিজনেস। এগুলো ম্যাক্সিমাম বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির ব্র্যান্ড, আসে ভারত হয়ে। কথা হলো- এই সাবান, শ্যাম্পু, সেন্ট বানানো কিন্তু কঠিন কোন বিষয় না, এখানে আহামরি কোন প্রযুক্তি নেই। আপনাকে কাচামাল এনে দিলে আপনিও বাসায় বসে বানাতে পারবেন। ঢাকার চকবাজার বা কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় এলাকায় এরকম বহু ব্যবসায়ী আছে, যারা এগুলো বানাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হইলো তাদের ব্র্যান্ড নাই। তারা ঐ বহুজাতিক কোম্পানি বোতল সংগ্রহ করে, সেটার মধ্যে তাদের বানানো জিনিস ভরে সেল করে। যদিও সরকারীভাবে এদের নাম দেয়া হয়েছে ‘নকল কসমেটিকস’, কিন্তু এদের আসল করে দিলে সমস্যা কোথায় ? সরকার এসব ব্যবসায়ীকে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দিক, তাদের ব্র্যান্ড দিয়ে দিক, তাদের মান-নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর নির্দেশণা দিক, দেখবেন ওরা কত ডেভেলপ করে। কিন্তু সেটা না করে, কয়েকদিন পর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চকবাজারে গিয়ে নকল পণ্য দমন অভিজান করে, তাদের কারখানা সিলগালা করে, ডজনখানেক গ্রেফতার করে।
আরে ভাই দেশের মানুষ, দেশে বসে পণ্য বিক্রি করে, আর আপনি বিদেশী কোম্পানির হয়ে দেশী মানুষকে নকল ট্যাগ দেন, এর থেকে জঘন্য দেশবিরোধী কাজ আর কি হতে পারে ?
আমি জানি, দেশী কসমেটিকসের কথা শুনলে, অনেকের মনে খুত খুত করবে আর ভাববে- তারা কি বিদেশীদের মত মাননিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
ঐ যে বললাম- দেশী মানুষের উপর আমার-আপনার আস্থা নাই।
দেশী কোম্পানি বলে হয়ত দুইটা গালি দিতে পারবেন,
কিন্তু বিদেশী কোম্পানিকে কি কিছু বলতে পারছেন কখন ?
এই যে জনসন এন্ড জনসনের মত বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ কোম্পানির পণ্য ব্যবহার করে ক্যান্সার হইছে, এটা নিয়ে আপনার মনে কি উদ্রেগ হয় নাই, বিদেশী বলেই অন্ধ বিশ্বাস করা কখনই ঠিক নয়।
একইভাবে বাংলাদেশে গাড়ি শিল্প ডেভেলপ করতে দেয় না। সরকার হয়ত ভাবে, গাড়ি থেকে উচ্চমূল্যে ট্যাক্স পায়। কিন্তু এতে তো জনগণের খরচ তো বেড়ে গেলো, তাহলে লাভ হলো কোথায় ?
মোটামুটি যেসব পার্টস আপাতত দেশে বানানো যাচ্ছে না, সেগুলো আমদানি করে দেশে গাড়ি শিল্প ডেভেলপ করা যায়। একইভাবে মোবাইলের চাহিদা প্রচুর। যতটুকু পার্টস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ততটুকু করে বাংলাদেশে মোবাইল বানানো যায়।
একইভাবে কৃষিপণ্য যা বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে, তা দেশে করা যায় কি না ?
প্রয়োজনে রিসার্চ/গবেষণা করা যেতে পারে। আলাদা টিম বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে এসে তা শুরু করতে পারে। ১ দিনে কোন কিছুই হবে ৫-১০ বছরের টার্গেট নিয়ে কাজ করলে কোন কাজাই অসম্ভব না।
এতো গেলো পণ্য আমদানি, এবার যদি ‘সেবা আমদানি’র কথা ভাবি,
ভারতীয়রা বাংলাদেশের জব সেক্টরে ঢুকে ১০ বিলিয়ন ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।
দেশের মানুষকে প্রয়োজনে ট্রেনিং দিয়ে দেশী লোককেই চাকুরী দেয়া যায়।
এতে এই ৮০ হাজার কোটি টাকা বাইরে যাওয়া থামানো যাবে।
একইভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে।
অনেকের মতে, এই অ্যামাউন্টটা ১০-২০ হাজার কোটি টাকার মত।
আপনি বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো ডেভেলপ করেন, চিকিৎসা সেবা ডেভেলপ করেন,
কাস্টমার কেয়ার ডেভেলপ করেন। দেখবেন-
বাংলাদেশের রোগী বাংলাদেশেই থাকবে, ফলে দেশের টাকা বাইরে যাবে না।
একদিনে হয়ত হবে না, কয়েক বছরের বছরের টার্গেট নিয়ে করতে হবে।
একইভাবে মোবাইল সেবাদানকারী বিদেশী কোম্পানিগুলো সব টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে,
দেশী মোবাইল কোম্পানিকে ডেভেলপ করে দেশের টাকা দেশেই রাখা উচিত।
একটা বিষয় মনে রাখবেন-
চায়না আজকে বিশ্বজুড়ে মার্কেট ধরতেছে, তারা শুরুটা করছিলো দেশের মার্কেটকে কেন্দ্র করে।
এরপর ধিরে ধিরে তারা বিদেশে বিস্তার লাভ করছে। একইসূত্রে আমাদেরও নিজের দেশের মার্কেট নিয়ে আগে চিন্তা করা উচিত। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। এটা কিন্তু ছোট কোন মার্কেট না।
এই মার্কেট নিয়ে চিন্তা করলেই অনেক কিছু করা সম্ভব। বিদেশীরা এসে সেই মার্কেট দখল করতেছে,
আর আমরা আছি, বিদেশের মার্কেট দখল করার চিন্তায়, আশ্চর্য।
যাই হোক, আমার কথা হলো- বিদেশের টাকা দেশে আনতে আমরা যে পরিমাণ ঘাম ঝরাচ্ছি,
তার সমপরিমাণ ঘাম যদি দেশের টাকা দেশে রাখতেই ঝরানো যেতো, তবে আরো দ্রুত কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব ছিলো।
১ম পর্ব- https://bit.ly/2kB3dKW
২য় পর্ব- https://bit.ly/2lRojEW