বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণের পেছনে ছুটে আমাদের লাভ কতটুকু ? -২ এন.সি-১৭০

বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণের পেছনে ছুটে আমাদের লাভ কতটুকু ? -২
বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণের পেছনে ছুটে আমাদের লাভ কতটুকু ? -২
অনেকের ধারনা বিদেশী ঋণ/বিনিয়োগ না আসলে দেশ চলতে পারবে না।
আবার অনেকে বলে, বিদেশী ঋণ বা বিনিয়োগ না আসলে দেশ উন্নত হবে কিভাবে ?
যারা এ ধরনের দাবী করে, তারা হয়ত জানে না-
বাংলাদেশে কতটুকু বিদেশী ঋণের উপর নির্ভরশীল।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয় বাংলাদেশের যে ৫ লক্ষ কোটি টাকা বাজেট হয়, তার মাত্র ৫% হচ্ছে বিদেশী ঋণ।
অর্থাৎ সংখ্যার হিসেবে তা আনুমানিক ২৫ হাজার কোটি টাকা। (https://bit.ly/2lNXbqw)
আবার প্রায় শোনা যায়, অমুক বিদেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ঋণ দিয়ে অমুক স্থাপনা বানিয়ে দিচ্ছে, তমুক স্থাপনা বানিয়ে দিচ্ছে।
আসলে এক্ষেত্রে প্রথমে দেশের টাকা খরচ করে বানানো শুরু করতে হয়, এরপর বিদেশীরা তাদের মজ-মর্জি মত টাকা(শ্রম/মালামাল) দিয়ে থাকে।
কিন্তু সেই দেয়ার পরিমাণ কতটুকু সেটা হিসেব করার দরকার আছে।
মুখে যত টাকার কথা বলুক, বাস্তবে তারা কতটুকু টাকা (শ্রম/মালামাল) দেয়,
সেটার হিসেব দেখার টার্ম হলো- ‘বৈদেশিক অর্থ ছাড়’
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিলো ৪৫২ কোটি ডলার।
তবে একই সময়ে বিদেশী ঋণ ও সুদ শোধ করা হয়েছে ১২১ কোটি ডলার,
এর মধ্যে মূলধন ৮৯ কোটি এবং সুদ ৩১ কোটি ডলার।
তাহলে হিসেব মত বিদেশ থেকে আসলো = ৪৫২-১২১ কোটি ডলার=৩৩১ কোটি ডলার বা আনুমানিক ২৫ হাজার কোটি টাকার মত। (https://bit.ly/2lOwgL8)
এবার আসুন- আরো দুটি হিসেব দেখি-
১) গত ১ বছরে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স এসেছে = ১৬৪২ কোটি ডলার = ১ লক্ষ ৩১ হাজার কোটি টাকা।
২) গত ১ বছরে পোষাক খাত থেকে এসেছে =৩৪০০ কোটি ডলার= ২ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা ।
অর্থাৎ বিদেশী ইনভেস্ট/ঋণের তুলনায় প্রবাসী আয় ছিলো ৫ গুন আর পোষাক খাতে আয় ছিলো ১০ গুন।
এই হিসেবগুলো এ কারণে বললাম-
সরকার বিদেশী ঋণ/বিনিয়োগ আনার জন্য যে বিপুল পরিমাণ দৌড় ঝাপ করে,
তার আলটিমেট সফলতা কতটুকু ? মাত্র ২৫ হাজার কোটি টাকা ??
অথচ প্রবাসীরা আনছে ১ লক্ষ ৩১ হাজার কোটি, গার্মেন্টস খাত আনছে ২ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা !
আপনি একটু মিডিয়ার খবরগুলোর দিতে তাকান-
প্রতিটা মন্ত্রী-মিনিস্টার বার বার বিদেশীদের কাছে গিয়ে হাত পায়ে ধরতেছে তারা যেন ঋণ দেয় বা বিনিয়োগ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হচ্ছে, তা টাকা প্রাপ্তির এ্যামাউন্টই বলে দিচ্ছে।
সত্যিই বলতে বিদেশীদের ঋণ/বিনিয়োগ আনতে গিয়ে দেশের মন্ত্রী মিনিস্টাররা যে পরিমাণ ঘাম ঝড়াচ্ছে,
যত পলিসি হাতে নিচ্ছে, তার ১০ ভাগের ১ ভাগও যদি প্রবাসী শ্রমিক বা গার্মেন্টেসের জন্য করতো তবে তবে দেখা যেতো এসব খাতে ইনকাম আরো কয়েকগুন বাড়ানো সম্ভব ছিলো। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, প্রবাসী শ্রমিক বা গার্মেন্টসের ব্যাপারে সরকার অনেকটাই বেখেয়াল, তারা নিজেরাই যতটুকু পারতেছে, করতেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্যই করা হয় না, কিংবা নেয়া হয় না নতুন কোন পলিসি বা উদ্যোগ যার মাধ্যমে এ খাতে আয় বাড়ানো যায়। যেমন ধরুন- “ইশতেহার : ‘জেগে ওঠো বাংলাদেশ ২০১৮” এর মধ্যে কিন্তু আমি বলেছিলাম- সাধারণ শ্রমিক রফতানি পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানি করে রফতানি করা অনেক বেশি লাভজনক। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। সরকার একটু কৌশলী হলেই প্রবাসী আয় কয়েকগুন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোন চিন্তাই নাই। (https://tinyurl.com/yxj4q848)।
আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে সরকারের কোন দৃষ্টি নাই। সরকারের অদূরদর্শী কূটনীতির ফলে অ্যাকর্ড আলায়েন্সের মত কূচক্রী বিদেশীরা আমাদের গার্মেন্টসগুলোকে পিষে খাচ্ছে। গতকালকের এক রিপোর্টে দেখলাম গত ৬ মাসে ৪৬টি পোষাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, বেকার হয়েছে ২৫ হাজার শ্রমিক। (https://bit.ly/2kgSDZc)
এছাড়া বিদেশী অনেক বায়ার টাকা আটকে দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেয় হয় না সেই টাকা উদ্ধারের। মূল কথা হলো বিদেশে কাজ/ব্যবসা করতে হলে সরকারকে হতে হবে গার্জিয়ান। কিন্তু বাংলাদেশের পোষাক শিল্প বলেন আর প্রবাসী শ্রমিক বলেন, সবাই কাজ করে এতিমের মত। অথচ সরকার বিদেশী ঋণ আর বিনিয়োগের পেছনে যে শ্রম ও পলিসি খরচ করে, তার দশভাগের ১ ভাগও যদি এই দুই সেক্টরে করতো তবে বহুগুন বেশি আয় করা সম্ভব ছিলো।
অনেকে হয়ত বলতে পারেন, সরকার আবার বিদেশীদের জন্য কি করলো ?
অনেক কিছুই তো করলো। এই যে বাংলাদেশে এত এত রাস্তাঘাট-সেতু-ফ্লাইওভার,এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে, এগুলো কেন হচ্ছে ? দেশী শিল্পের জন্য ? এগুলো যদি দেশী শিল্পে জন্য হয়, তবে প্রতিদিন দেশী শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন ? কেন গার্মেন্টস শিল্পে বেহাল অবস্থা, কেন চামড়া শিল্প মরে যায় যায় অবস্থা ? (বণিকবার্তার খবর: ১০ মাসে বন্ধ ২০৯ শিল্প কারখানা)
সরকারের পলিসি হইলো, এইসব রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর, বিমানবন্দর বানাইলে বিদেশীরা আকৃষ্ট হবে, বিনিয়োগ করবে। এজন্য তারা অনেক বড় বড় প্রকল্প হাতে নিছে। জনগণের টাকা দিয়ে শুরু করছে, ভাবছে বিদেশীরা হয়ত টাকা দিয়ে তাদের কাজ আগায় নিবে। কিন্তু কথা হইলো- সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা উঠায় দেদারসে খরচ করছে, রিজার্ভের জমা রাখা টাকাও টান দিছে খরচ করার জন্য (https://tinyurl.com/yxd49okv), রাষ্ট্রয়াত্ব সংস্থার জমে থাকার অর্থ খরচ করতে চাচ্ছে এই খাতে (https://bit.ly/2kzBt9y)। কিন্তু কথা হইলো- সরকার দেশের টাকা দেদারসে খরচ করলেও বিদেশীরা কিন্তু সে অুনপাতে টাকা বাড়ায় নাই। ফলে মিডিয়ায় প্রায় খবর আসে- অপরিকল্পতি প্রজেক্ট করে খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার (http://archive.fo/og0FV)। অর্থমন্ত্রী বলে টাকা লাগলে টাকা ছাপানো হবে (https://bit.ly/2kk4TZ2)। মানে টাকা নেয়া হবে জনগণের থেকেই সেটা যেভাবেই হোক (মূল্যস্ফীতি করে)।
আমি একটু হিসেব করে দেখলাম-
বিদেশীরা যে ইনভেস্টগুলো করছে তার প্রায় সবগুলো হলো বিদ্যুৎসেক্টরে। আসলে বিদেশীরা তো এমনি এমনি ইনভেস্ট করে না, তাদের অনেক হিসেব করেই ইনভেস্ট করে। তারা দেখেছে এই সেক্টরে খরচ করলে লাভ আসবে। এ কারণে অন্যান্য প্রকল্পে হেন-তেন বলে কালক্ষেপন করলেও কিন্তু বিদেশী ইনভেস্টে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কাজ মোটামুটি ভালো করেই চলছে।
কথা হলো- বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ পর্যাপ্তের তুলনায় বেশি আছে। কিন্তু তারপরও সরকার রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র (ভারত), রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র (রাশিয়া), মাতাবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র (জাপান), মেঘনা ঘাটে বিদ্যুকেন্দ্র (ভারত), পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র (চীন), বাশখালিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র (দেশী), ফুলবাড়িয়াতে বিদ্যুৎকেন্দ্র (চীন) এরকম বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরীর করছে। কথা হলো, দেশের কলকারখানাগুলো যখন স্ব-উদ্যোগী বা ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দিকে ঝুকছে এবং দেশের বিদ্যুতের চাহিদাও যেখানে ফুলফিল, সেখানে সরকার এত বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো করছে কার জন্য ? অনেক মিডিয়াতে খবরে এসেছে, এত এত বিদ্যুৎকেন্দ্র ভবিষ্যতে দেশের জন্য গলার কাটা হতে পারে । (https://bit.ly/2lOwl1o)
আর শুধু বিদ্যুৎ নয়, সরকার বিশাল এমাউন্ট খরচ করে বিদেশ থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করছে, যার ভর্তুকি তোলা হবে আবার জনগণের থেকে।
তবে আমি যেটা বুঝি-
সরকার যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে, সেটার প্রতি যেন বিদেশীরা আকৃষ্ট হয় এজন্য জ্বালানি শক্তি পর্যাপ্ত মজুদ রাখছে।
আমার কথা হলো- সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এই মহাসমারোহ করছে, এত এত খরচ করছে, এত এত বুদ্ধিমত্তা ব্যয় করছে- এর দ্বারা কতটুকু বিদেশী বিনিয়োগ সরকার আনতে পারলো সেটার আগে হিসেবে চাওয়া উচিত।
পাশাপাশি এটাও বলা উচিত- বিদেশীদের আকৃষ্ট করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ, সময়, বুদ্ধি খরচ করা হলো, তার সিকিভাগও যদি দেশী শিল্প-ব্যবসায়ীদের বা প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের জন্য জন্য করতো, তবে বহুগুন লাভ করা সম্ভব ছিলো।
আমি এজন্যই হিসেবগুলো আবার দিলাম, কথাগুলোও আবার বললাম-
বিদেশী থেকে ঋণ/বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ২৫ হাজার কোটি টাকা, সেখানে আমাদের শ্রমিক দ্বারা রেমিটেন্স এসেছে ১ লক্ষ ৩১ হাজার কোটি, আর পোষাক খাত থেকে এসেছে ২ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি। সরকার বিদেশীদের জন্য যে ঘাম ঝড়াচ্ছে, তার সিকি অংশও যদি দেশীদের জন্য করতো, তবে দেশের জনগণই দেশের জন্য বহুগুন টাকা এনে দিতে পারতো। অর্থাৎ বিদেশীর টাকায় নয়, দেশীর টাকায় দেশ সিঙ্গাপুর-লস অ্যাঞ্জেলস বানানো আরো আগে সম্ভব। (চলবে)