দেশে ব্যবসায় মন্দা, জুয়া আর সুদের জয়জয়কার... এন.সি- ১৫৪

দেশে ব্যবসায় মন্দা, জুয়া আর সুদের জয়জয়কার
Related image
দেশে ব্যবসায় মন্দা, জুয়া আর সুদের জয়জয়কার
উদ্যোক্তাদের কি ব্যবসা বাদ দিয়ে জুয়া আর সুদের দিকে ঢেলে দেয়া হচ্ছে ?
আমরা প্রায় একটা কথা শুনি, দেশে বিনিয়োগ নাই, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।
অপরদিকে সম্প্রতি ক্যাসিনো ব্যবসার গোমর ফাঁস হওয়ার পর দেখা গেলো, যুব সমাজ তাদের সংসারে রক্ষিত কোটি কোটি টাকা নিয়ে এসে এই ক্যাসিনোতে ব্যয় করেছে। তার দৃষ্টিতে এটাও এক ধরনের ইনভেস্ট, যার মাধ্যমে দ্রুত বহুগুন লাভ করা যায়। তাদেরকে যদি বলা হয়, এই টাকা ব্যবসায় ইনভেস্ট না করে জুয়াতে ইনভেস্ট করলে কেন ? তখন সে বলছে- দেশের ব্যবসায়ীক পরিস্থিতি ভালো না। কিন্তু ক্যাসিনোতে ইনভেস্ট করলে এক রাতে যদি লেগে যায়, তবে ১০ গুন সম্পদ করা সম্ভব। শুধু ক্যাসিনো নয়, আইপিএল-বিপিএল হলে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে জুয়া। বড় বড় ব্যবসায়ীদের জীবন কাহিনী শুনলে পাওয়া যায়, তারা কষ্ট করে কিছু টাকা জমিয়ে ব্যবসা শুরু করে, আর বর্তমানে দেখা যায় তরুণ সমাজ কষ্ট করে টাকা জমিয়ে জুয়াতে লাগায়।
অপরদিকে, আরেকটি শ্রেণী আছে, যারা ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা বসিয়ে রেখে সুদ খাচ্ছে, কোন ব্যবসায় ইনভেস্ট করতেছে না। তাদের দাবী দেশের ব্যবসায়ীক পরিস্থিতি ভালো না। ব্যবসায় ইনভেস্ট করলে লস হতে পারে। অপরদিকে ব্যাংকে টাকা রাখা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং নির্দ্দিষ্ট সময় পরে সুদ পাওয়া যায়।
অর্থাৎ একদিকে দ্রুত বড় লোক হওয়ার লোভ, অন্যদিকে বসে থেকে মাস শেষে সুদের টাকার লোভ। দেশে কেন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে, সে জন্য আমি ৪টি কারণ চিহ্নিত করেছি-
১. সরকারের দোষ: সরকার দেশী উদ্যোক্ততাদের প্রতি অনাগ্রহ এবং বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রতি অতি আগ্রহ। দেশী ব্যবসায়ীরা কিছু শুরু করলেই তাদের সাহায্য করা তো পরের কথা, কিভাবে তাদের ল্যাং মেরে ফেলে দেয়া যায়, সরকারের শুধু সেই চিন্তা। দেশে ব্যবসা করার পথ রুদ্ধ হচ্ছে বলেই, সমাজ অলস টাকা নিয়ে জুয়া আর সুদে খাটাচ্ছে। আর জুয়া আর সুদের আলটিমেট লাভবান হচ্ছে সরকার ও তার দলীয় লোকজন। জুয়ার টাকা যেমন সরকার দলীয় লোক নিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসায় টাকা না খাটিয়ে ব্যাংকে সুদের জন্য জমা রাখলে সেই টাকা লোপাট করছে সরকার নিজেই।
সরকার যদি সত্যিই দেশী উদ্যোক্তাদের সুযোগ ও সুবিধা দিতো, তবে তরুণ সমাজ জুয়া আর সুদের দিকে না ঝুকে অবশ্যই বৈধ ব্যবসার দিকে ঝুকতো।
২. পাঠ্যবই ও শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা : আমাদের পাঠ্যবই ও শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের চাকুরী করতে শিখায়। কিন্তু উদ্যোক্তা হতে শিখায় না। এতে দিন শেষে টাকা জমলে কি করতে হবে সেটা আমাদের মাথায় নাই। তাই সেই অজ্ঞতা থেকেও অনেকে জুয়া আর সুদে ইনভেস্ট করছে।
এছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবমুখী না। একটা ছেলে জীবনের অর্ধেক সময় পার করে অনার্স/মাস্টার্স শেষ করে, কিন্তু সেই পড়ালেখায় নিজস্বভাবে সে উৎপাদনক্ষম হয় না। হয়ত অন্যের অধীনে চাকুরী করে উৎপাদন করতে পারে, কিন্তু নিজে নিজে কিছু করার শিক্ষা এই শিক্ষাব্যবস্থায় দেয়া হয় না।
৩. ধর্মীয় দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা : মাদ্রাসা থেকে প্রতিনিয়ত অনেক মাওলানা বের হচ্ছে, কিন্তু মানুষের মাঝে অপকর্ম যেন সেই অনুপাতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকাল ওয়াজ মাহফিলের আলোচনার বিষয় হলো কোন গায়ক কি করছে, কোন নায়ক কি নাচছে, অনেকে আবার সেগুলোর অনুকরণ করে মানুষকে হাসায়-কাদায়। কিন্তু বাস্তবে ধর্মীয় দায়িত্বশীলদের যে দায়িত্ব ছিলো, সেটা তারা পালন করছে না। অথচ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামে যে সুদ বা জুয়া নিষিদ্ধ, এগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের মাঝে শক্ত অবস্থান তৈরী করতে এবং প্রতিবাদ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অনেকে আবার জনতার সাথে মিশে নিজেও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আবার নিজের ফেসভ্যালু ঠিক রাখার চেষ্টা করে ওয়াজ করে। সে এমন কিছুর বিরুদ্ধে বলতে চায় না, যা অধিক জনগণ পছন্দ করে। যেমন- ক্রিকেট/ফুটবল খেলা নিজেই এক ধরনের জুয়া, কিন্তু মসজিদগুলোতে ক্রিকেট/ফুটবল খেলার বিরুদ্ধে ওয়াজ হয় না। অথচ অনেক মাদ্রাসা বিকেল বেলায় তাদের মাঠে ফুটবল/ক্রিকেটের আয়োজন করে।
পাশাপাশি মসজিদ মাদ্রাসা কমিটিতে যদি কেউ সুদ/জুয়ার কারবার করে, তবে তাদের খুশি রাখতেও সুদ/জুয়ার বিরুদ্ধে ওয়াজ করতে চায় না অনেক ইমাম।
৪. জনগণের মধ্যে লোভ লালসা বৃদ্ধি: আমি একটা বিষয় সব সময় দেখেছি, মানুষ সব কিছু দ্রুত চায়। আবার কোন কিছু পেতে কষ্টও করতে চায় না। এই দ্রুত চাওয়া ও কষ্ট না করার মানসিকতা থেকে সে জুয়ার দিকে ঝুকে। অথচ দ্রুত চাওয়ার ফলাফল যে সব সময় ভালো হয় না, এটাও সে বুঝতে চায় না।
আবার মানুষ সব কিছুর মধ্যে লাভ চায়। কিন্তু ব্যবসা মানে লাভ-লস দুইটাই। কিন্তু সে শুধু লাভ চায়, লস চায় না। এর কারণে তারা সুদের দিকে ঝুকে। কিন্তু সুদে উপর দিয়ে লাভ হলেও দিন শেষে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তার লসই হয়। সমাজে এখন অধিকাংশ জনগণের মধ্যে এই ধরনের লোভ-লালসাযুক্ত মানসিকতা বিদ্যমান।
আমার মনে হয়, বর্তমান সমাজে সুদ ও জুয়া মহামারি থেকেও ভয়াবহ অবস্থায় বিরাজ করছে। কোন সমাজে যখন সুদ ও জুয়া বিদ্যমান থাকে, সেই সমাজে প্রকৃত ও সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়া আসলেই অসম্ভব বিষয়। তাই যে করেই হোক- সুদ আর জুয়া নামক মহামারিকে আগে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে।