রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-৭ । এন.সি- ১৮৪

রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-৭

Related image
রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-৭
কেউ কেউ বলছেন- রোহিঙ্গাদের কারণে এক সময় দেশের পরিস্থিতি ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মত হবে।
যারা এ ধরনের কথা বলছেন, তাদেরকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই-
১) জেরুজালেম ইহুদীদের জন্য তীর্থস্থান। সে স্থানকে কেন্দ্র করে বহুদিনের একটি প্ল্যান নিয়ে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে জড়ো হয়েছিলো। ইহুদীদের মত সেরকম কোন প্ল্যান নিয়ে কি রোহিঙ্গারা এসেছে ? কিংবা বাংলাদেশের ভেতরে কি তাদের কোন তীর্থ স্থান আছে ?
২) ইহুদীদের মধ্যে শিক্ষার হার বেশি, গবেষণাও বেশি। অপরদিকে রোহিঙ্গারা প্রায় অধিকাংশ শিক্ষিত নয়, আর গবেষনা তো স্বপ্নেও কল্পনা করা যাবে না। তাহলে রোহিঙ্গা আর ইহুদীদের মধ্যে তুলনা হয় কিভাবে ?
৩) ইহুদীরা কিন্তু ঐ সময় ইউরোপে ভালো অবস্থায় ছিলো, হিটলার হয়ত তাদের মেরে পাঠিয়েছে। অপরদিকে রোহিঙ্গারা গত ৩০ বছরে ধরে নাগরিকত্বহীন, ৫০ বছর ধরে গণহত্যা নির্যাতনের শিকার। শক্তিশালী অবস্থানে থাকা ইহুদীরা প্যালেস্টাইনে এসে নতুন ফন্দি আটতে পেরেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কি সে অবস্থা আছে, যে বাংলাদেশে এসে তারা নতুন কিছু করতে পারবে ? তারা যদি কিছু করতেই পারতো, তবে নিজ ভূমিতেই তো করতে পারতো।
৪) ফিলিস্তিনে কিছু ইহুদী গেলেও ইহুদীদের একটা বড় অংশ আমেরিকা বা ইউরোপে ছিলো। এদের একটি বড় অংশ আবার ধনী, বড় বড় বিজনেজ জায়ান্ট। কথা হলো রোহিঙ্গারা কি বিভিন্ন দেশে বিজনেজ জায়ান্ট হিসেবে আছে ?
৫) অনেকে হয়ত বলতে পারেন- “তাদের নিজেদের কিছু না থাকতে পারে, সম্রাজ্যবাদীরা তাদের সাহায্য করবে।” বুঝলাম, কিন্তু এখন পর্যন্ত সব বড় বড় সম্রাজ্যবাদীদের অবস্থান রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। এমনকি কেউ যদি কিছু দেয়, তবে সেটা ক্যাম্পে ভিক্ষার মত, এর বেশি না।
৬) রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে সেই ৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে আসছে, আগের সরকারের আমলে তাদের ফেরত পাঠানোও হয়েছিলো। ইহুদীরা ফিলিস্তিনে আসার পর কি তারা আবার ইউরোপে ফেরত গিয়েছিলো?
এবার হয়ত প্রশ্ন করবেন-
তাহলে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের স্ম্যার্টকার্ড ব্যবহার করে, ১ কেজি স্বর্ণ গিফট পায়, ক্যাম্পে অস্ত্রের ঝনঝনানি, যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা, বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্র দখল করে নেয়া, এসব খবর দেখে আপনি বলেন ?
আসলে যে নূর ডাকাতের কথা বলা হচ্ছে সে স্ম্যার্টকার্ড ব্যবহার করতো, মেয়ের নাক ফোরানোর অনুষ্ঠানে ১ কেজি স্বর্ণ গিফট পেয়েছে (বাংলাদেশীরা গিফট দিয়েছে), এই নূর ডাকাত কিন্তু ২ বছর আগে মিয়ানমার থেকে আসেনি, এসেছে ৩০ বছর আগে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে মাদক, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিলো।
বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যেও অনেক সন্ত্রাসী আছে, কিন্তু সে জন্য যদি আপনি সব বাংলাদেশীদের এক পাল্লায় মাপেন, তবে বিষয়টি অনেকটা দাড়ায় আমেরিকার মত- “মুসলিম মাত্রই সন্ত্রাসী”। এই টাইপের কথা।
একটি অভিযোগ শুনছি, রোহিঙ্গারা নাকি কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ রিকশা, টমটম এগুলো চালাচ্ছে। আসলে বাংলাদেশে যে কর্মহীনতা বা বেকারত্বের কথা বলা হয়-
এটা কিন্তু শিক্ষিত বেকার, শ্রমজীবী বা গায়ের খাটুনিতে কিন্তু বাংলাদেশে কর্মের অভাব নাই, বরং অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক না পাওয়ারও খবর আসে। তাই রোহিঙ্গারা যদি কিছু ইনকাম করার জন্য কক্সবাজারে গায়ের খাটুনি করে, তবে এটা নিয়ে আলগা বিদ্বেষ ছড়ানোর কোন কারণ দেখি না।
আরেকটি কথা হলো-
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রের ঝনঝনানি বা যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যার বিষয়।
আমি যুবলীগ নেতার হত্যার বিষয়টি নিয়ে অনেক মিডিয়াতে খবর দেখলাম।
খবরের অধিকাংশ হেডিং ছিলো- “ইয়াবা বিরোধী যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করলো রোহিঙ্গারা”।
যারা এ ধরনের খবর বানান, তারা কি আদৌ টেকনাফের যুবলীগের সম্পর্কে কোন ধারণা আছে ?
টেকনাফ যুবলীগের মূল কাজটা কি ? আসুন সে সম্পর্কে কিছু খবর দেখি –
১) টেকনাফে ৭১ হাজার ইয়াবা উদ্ধার, যুবলীগ নেতা আটক
(https://bit.ly/2lBGOgI)
২) ইয়াবা ব্যবসা করে টেকনাফে যুবলীগ নেতার ডুপ্লেক্স বাড়ি
(https://bit.ly/2lwaWKm)
৩) ইয়াবায় জড়িত অভিযোগে উখিয়ায় যুবলীগের কমিটি বাতিল
(https://bit.ly/2lRIr9U)
৪) ইয়াবা জগতের কিং যুবলীগ নেতা ফজল কাদের গ্রেপ্তার এড়াতে ভারতে
(https://bit.ly/2lDrpw1)
কথা হলো- ইয়াবা ব্যবসায় অভিযুক্ত পুরো স্থানীয় আওয়ামীলীগ-যুবলীগ নেতারা। সেখানে হঠাৎ করে এক ইয়াবাবিরোধী যুবলীগ নেতা পাওয়ায় আমার তো মনে হয় তাকে যাদুঘরে সাজিয়ে রাখা দরকার ছিলো।
তারপর ধরে নিলাম- ঐ যুবলীগ নেতা নির্দোষ। কিন্তু এখানে যেটা বোঝা যায়-
ঘটনা হইলো, ১১ লক্ষ রোহিঙ্গার মধ্যে সন্ত্রাসী গুন্ডা পান্ডা থাকা স্বাভাবিক। এবং দরিদ্রতার কারণে অন্যদের থেকেও বেশি থাকতে পারে। কিন্তু এই সন্ত্রাসীদেরকে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন লোকাল গডফাদাররা ব্যবহার করছে। একদল ইয়াবা ব্যবসায়ী অন্যদলকে খুন করাচ্ছে, কিন্তু সেটা করাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদেরকে দিয়ে। এতে যত দোষ নন্দ ঘোষের মত রোহিঙ্গাদের ঘাড়ে দিয়ে পড়তেছে, সেই দোষ, ফলে আড়াল হয়ে যাচ্ছে মূল গডফাদাররা।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, কোন একটি মহল দুই জাতিকেই (বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা) পরষ্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে। যেমন কয়েকদিন আগে ২৮শে আগস্টের খবর- রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি এনজিও ত্রাণ বিলি করতেছিলো, এ সময় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ গিয়ে সেই ত্রাণ লুট করে নিয়ে যায়, যার মূল্য ছিলো প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী হয়। এই খবরটি উখিয়ার একটি লোকাল পোর্টালে আসে। কিন্তু ১ দিনের মধ্যে খবরটি মুছে দেয়া হয়। যদিও তা ওয়েবক্যাশে রয়ে গেছে। (https://bit.ly/2luyeA9)
এই খবরটিতে স্পষ্ট- কোন একটি মহল দুই দিকেই সক্রিয় আছে। একদিকে বাংলাদেশীদের ক্ষেপানো হচ্ছে রোহিঙ্গা বিরোধী খবর নিয়ে, আবার অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মালামাল লুট করে রোহিঙ্গাদের ক্ষেপানো হচ্ছে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে, যদিও সেই খবর মুছে দেয়া হচ্ছে, যেন বাংলাদেশের মানুষ সে খবর পেয়ে নিউট্রাল না হয়ে যায়।
এখানে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট-
স্থানীয় বাংলাদেশীদের সাথে রোহিঙ্গাদের একটি আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ৪০ বছর ধরেই ছিলো, এখনও আছে (এরকম অনেক জেলার সাথেই অনেক জেলার দ্বন্দ্ব আছে, যেমন: নোয়াখালি-চট্টগ্রাম দ্বন্দ্ব, বরিশাল-নোয়াখালী দ্বন্দ্ব)। তবে বর্তমানে সেই দ্বন্দ্বটা স্বার্থগত বিষয়ের কারণে বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই স্বার্থগত দ্বন্দ্বটা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসছে বিভিন্ন মিডিয়া। এমনকি বাংলাদেশীরা যেন ক্ষেপে যায় এজন্য রোহিঙ্গাদের তারা ইহুদীদের সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা করতেছে না।
উল্লেখ্য বর্তমান চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বে মাঝখানে থাকা বাংলাদেশের উপর ভারতকে এচচেটিয়ে লেলিয়ে দিবে আমেরিকা। ফলে ভারত দিনে দিনে বাংলাদেশের উপর তার আধিপত্যসহ বিভিন্ন এগ্রেসিভ কাজ বৃ্দ্ধি করতে থাকবে। এ মুহুর্তে বাংলাদেশ-ভারতীয় দ্বন্দ্ব হওয়া স্বাভাবিক। এবং বাংলদেশীদের প্রতিবাদের কারণে ভারতের অনেক ষড়যন্ত্র হয়ত রূখে দেয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা বন্ধ করতেই বাংলাদেশীদের দেখানো হচ্ছে-
"ভারতীয়রা নয়, বাংলাদেশের এক নম্বর শত্রু হলো রোহিঙ্গারা। সুতরাং যুদ্ধটা আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হোক।"
আরো সহজ ভাষায় যদি বলি, তারা সব সময় চায়-
মুসলমান-মুসলমান দ্বন্দ্ব লেগে থাকে, কোনভাবে ঐক্য না করতে পারে। অপরদিকে তারা (অমুসলিমরা) সব ঐক্যজোট হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাগতে পারে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাবিরোধী প্রোপাগান্ডার একেবারে মূলে ঢুকলে আমার তাই মনে হয়েছে।
রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-
প্রথম পর্ব-https://bit.ly/30IWC0L
দ্বিতীয় পর্ব- https://bit.ly/2HzGvLs
তৃতীয় পর্ব- https://tinyurl.com/y24946xc
চর্তুথ পর্ব- https://bit.ly/30MMp38
পঞ্চম পর্ব- https://bit.ly/30NQ7tk
ষষ্ঠ পর্ব- https://bit.ly/2kjlvQL