রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-৬ । এন.সি- ১৯২

রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-৬

Related image
রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-৬
রোহিঙ্গা সমাবেশ বিরোধী গুজবের পেছনে কে ?
আমি আপনাদের আগেই বলেছি, রোহিঙ্গা সমাবেশের পর একটি মহল হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বিরোধী গুজব তৈরীতে। এতে নেতৃত্ব দেয় বসুন্ধরা গ্রুপের কালের কণ্ঠ পত্রিকা। কালেরকণ্ঠ পত্রিকাটিকে ‘কলকাতার কণ্ঠ’ বলা যায়, কারণ কালেরকণ্ঠ পত্রিকাটির মালিক বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানকে মাত্র ৪ মাস আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মিডিয়া জগতে অবদানের জন্য বিশেষ পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। (https://bit.ly/2ZKmKqR)
(১) অভিযোগ: “রোহিঙ্গা সমাবেশের পেছনে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা”
ক) ২৫ তারিখে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ হয়। ২৬ তারিখ কালেরকণ্ঠ দাবী করে, এই সমাবেশের পেছনে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র আছে। মানে পাকিস্তান ভিত্তিক এনজিও ‘আল খিদমাত ফাউন্ডেশন’ সেখানে অর্থায়ন করেছে। যদিও এর পেছনে কোন দলিল না রেফারেন্স তারা দিতে পারেনি। (https://bit.ly/2Lc2HgK)
খ) পাকিস্তানের এনজিও রোহিঙ্গা সমাবেশের পেছনে আছে, এই গোপন তথ্যের রেফারেন্স (!) প্রথমে দিতে ব্যর্থ হলেও ২৮ তারিখে কালেরকণ্ঠ তার রেফারেন্স নিয়ে হাজির হয়। সেই রেফারেন্স হলো ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ‘ইউনাইটেড নিউজ অফ ইন্ডিয়া’ (ইউএনআই)। যদিও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের দাবীর পেছনে কোন সূত্র ছিলো না। (https://bit.ly/2ZpR6Uc)
গ) অতঃপর “রোহিঙ্গা সমাবেশের পেছনে পাকিস্তানের হাত আছে” চতুর্দিকে চেতনাবাদীদের মধ্যে হাওয়া ছড়াতে থাকে। একে একে বাংলাদেশের চ্যানেল আই, এনটিভি, ভারতের ইকোনোমিক টাইম সবাই কালেরকণ্ঠের রেফারেন্সকে পূজি করে খবর কপি করে। শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরও এক সভায় বলে বসে – রোহিঙ্গা সমাবেশের পেছনে পাকিস্তানের হাত আছে। (https://bit.ly/2Ln0Vs7)
কিন্তু সেই পাকিস্তানী হাতটা আসলে কিভাবে আছে, তার সূত্রই কেউ দিতে পারেনি।
(২) অভিযোগ : বাংলাদেশীদের ৩০ হাজার চাকুরী নিয়ে গেছে রোহিঙ্গারা
কালেরকণ্ঠ একটা খবর ছড়াইছে- রোহিঙ্গারা নাকি বাংলাদেশীদের ৩০ হাজার চাকুরী নিয়ে গেছে (https://bit.ly/2MNt0f6)
এই খবর দেখে- একদল বাংলাদেশী পারলে এখনই নেমে যায় রোহিঙ্গাদের জবাই করতে। এই কাণ্ডকারখানা দেখে আমি প্রয়াত কবি শামসুর রহমানকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। তিনি যদি “এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে” শিরোনামে কবিতাটি না লিখতেন, তবে আমরা বোধহয় হুজুগে বাঙালীর চরিত্র এক কথায় কখন বুঝাতে পারতাম না।
পাবলিক কালের কণ্ঠ থুক্কু কলকাতার কণ্ঠ পত্রিকাটির হেডিং দেখে লাফ দিলেও আসলে ভেতরে খবর পড়ে নাই, ভেতরে কিন্তু লেখা আছে এই ৩০ হাজার চাকুরী আসলে রোহিঙ্গা শরনার্থী নির্ভর এনজিও’র চাকুরী। অর্থাৎ যে এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করতে আসছে, তারাই রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। এখানে বাংলাদেশীদের চাকুরী খাওয়ার কি হইলো ?
তবে ৩০ হাজার রোহিঙ্গার চাকুরীর সংখ্যা নিয়ে গড়মিল লাগে, কালেরকণ্ঠ এখানেও রেফারেন্স ব্যবহার করে নাই।
উল্লেখ্য ১১ লক্ষ রোহিঙ্গার বিপরীতে ৩০ হাজার শুধু এনজিও কর্মী, তাও রোহিঙ্গা ! আর বাকি মিলালে কত হবে ? যদি ৫০ হাজার হয়, তবে ২০ জনের বিপরীতে ১ জন এনজিও কর্মী, কথাটা কতটুকু সত্য? আর ৩০ হাজার মোটামুটি শিক্ষিত রোহিঙ্গা আছে চাকুরী করার মত ??
এই সব আনন্দবাজার টাইপের গাজাখুরি কথা রটায় কালেরকণ্ঠ নিজের শেষ অবস্থানটাও শেষ করে দিচ্ছে।
তবে এই বিষয়ে ঘাটতে গিয়ে একটা মজার বিষয় টের পেলাম-
গত কয়েকদিনে বিভিন্ন মিডিয়ায় রোহিঙ্গা বিরোধী নিউজ করতে গিয়ে স্থানীয় কিছু লোকের রেফারেন্স ব্যবহার করা হইছে। এর মধ্যে আছে পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী এবং উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী (https://bit.ly/30zfsHAhttps://bit.ly/2ZBEHeR)।
এই লোকগুলোর নেতৃত্বে স্থানীয় কক্সবাজারবাসীর একটা গ্রুপ (যারা আসলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বেশ ক্ষেপে আছে। এই ক্ষেপে যাওয়া শুরু হয় গত জানুয়ারী মাসে। যখন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কাজে নিয়োজিত কিছু এনজিও এইসব স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীগুলোকে ছাটাই করে। তখন তারা এই দুই চেয়্যারম্যানের নেতৃত্বে কক্সাবাজারে আন্দোলন করে বলে, “রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কাজে নিয়োজিত এনজিওতে কাজ করার অধিকার আমাদের সববেচে বেশি। আমাদেরকে রোহিঙ্গা ত্রাণ কাজে নিয়োজিত চাকুরীতে কমপক্ষে ৭০% দিতে হবে, নয়ত এখানে আর কোন এনজিও’র কার্যাক্রম চালাতে দেয়া হবে না, এনজিওগুলোকে প্রতিহত করা হবে। (তথ্যসূত্র: https://bit.ly/2ZzOVN3https://bit.ly/2HCzcm3)
অর্থাৎ যে এনজিওগুলো এতদিন ভালো ছিলো, যে রোহিঙ্গারা এতদিন ভালো ছিলো,
যখনই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের চাকুরী থেকে ছাটাই করা হইছে, তখনই রোহিঙ্গা আর এনজিও’র খারাপ হয়ে গেছে। (এসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী কাজকর্ম কতটুকু পারে ? সততা কতটুকু আছে ?)
তবে আমি এখানে কোন সমস্যা দেখি না। এটাকে বলে “এলাকার ছেলেদের হক”।
আপনি বাংলাদেশে যে কোন কাজ করতে যান আগে আপনাকে এলাকার ছেলেদের হক পূরণ করতে হবে।
ধরেন আপনি বাড়ি বানাবেন, আপনাকে এলাকার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের থেকে ইট, বালু, সিমেন্ট, থাইগ্লাস, রড, ইলেকট্রিক মালামাল কিনতে হবে। যদি না কিনেন, তবে আপনার বাড়ি উঠানোই বন্ধ করে দিবে। এটা এলাকার ছেলেদের হক, এটা ফরজ।
আপনি কোন কারখানা দিতে যান, কোন দোকানপাট দিতে যান আপনাকে এলাকার ছেলেদের হক আগে পূরণ করতে হবে।
যতদিন আপনি এলাকার ছেলেদের হক পূরণ করবেন, ততদিন আপনি ভালো।
আর যেদিন হক বন্ধ করে দিবেন, সেই দিন থেকে আপনি খারাপ। আপনার ব্যবসা বন্ধ করতে তারা লেগে যাবে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় যে গোষ্ঠীটি ক্ষেপেছে তারা ঐ এলাকার হকদার ছেলে পেলে।
এতদিন তারা হক পেয়েছে তাই রোহিঙ্গাদের থাকতে দিয়েছে, এখন হকে টান পড়েছে, তারাও ক্ষেপে গেছে।
তবে এইটুকুর মধ্যে আমি কোন সমস্যা দেখি না।
সমস্যা তৈরী হয় তখন, যখন এলাকার হকদার ছেলেদের স্বার্থবাদী কথাগুলো বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যাচাই বাছাই না করে ছেপে দেয় এবং সেই কথাগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। আর তা সোশ্যাল মিডিয়ার হুজুগে মাতাল জনগণের কল্যাণ্যে মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশজুড়ে। (চলবে)
রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-
প্রথম পর্ব-https://bit.ly/30IWC0L
দ্বিতীয় পর্ব- https://bit.ly/2HzGvLs
তৃতীয় পর্ব- https://tinyurl.com/y24946xc
চর্তুথ পর্ব- https://bit.ly/30MMp38
পঞ্চম পর্ব- https://bit.ly/30NQ7tk
Image may contain: 3 people, text