রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-১ । এন.সি-১৯৫

রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-১

Related image
রোহিঙ্গা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক চিন্তাধারা-১
মুহিবুল্লাহ নামক এক ব্যক্তিকে নিয়ে খুব কথা হচ্ছে দেখলাম
১) তার দোষ সে ট্রাম্পের কাছে গিয়েছিলো, যে মিটিং এ প্রিয়া সাহা ছিলো,
২) এছাড়া সে রোহিঙ্গাদের দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসে সমাবেশ করিয়েছে,
৩) মুহিবুল্লাহ সেই সভায় বলেছে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পেলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।
৪) সভায় অনেক ইংরেজী ফেস্টুন ব্যবহার করা হয়েছিলো ? এগুলো অনেকের দৃষ্টিতে সন্দেহজনক ।
৪) মুহিবুল্লাহ আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা-পাসপোর্ট পেলো কিভাবে ?
১ম প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বুঝতে হবে- সে ট্রাম্পের কাছে গিয়ে কি বলেছে ?
সে কি প্রিয়া সাহার মত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিচার দিয়েছিলো ?
না সে বিচার দেয়নি, বরং ট্রাম্পের কাছে সহযোগীতা চেয়েছে, যেন আমেরিকা তাদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সহযোগীতা করে। অবশ্য ট্রাম্প এমনভাব দেখিয়েছে, রোহিঙ্গাদের সে চিনেই না।
সে যদি ট্রাম্পের কাছে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সহযোগীতা চায়, তবে এখানে দোষের কিছু দেখি না। বরং সে যে রোহিঙ্গাদের পক্ষ হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সহযোগীতা চাইতে গেছে, এটা বরং আমাদের সমর্থন জানানো উচিত।
২য় প্রশ্নের উত্তর হলো, ঐ দিন রোহিঙ্গারা কেন সমাবেশ করেছে ?
তাদের উপর যে গণহত্যা চলেছে তার ২ বছর পূর্তি হিসেবে। সবাইকে দেখলাম দুই হাত তুলে মোনাজাত করছে। কান্নাকাটি করছে। একটা নিপীড়িত গোষ্ঠীর গণহত্যা দিবসে এক হয়ে, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে, এখানে সমস্যাটা কি তা আমার মাথায় আসলো না ?
৩য় প্রশ্নের উত্তর হলো, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পেলে তারা মায়নামারে ফিরে যাবে না।– এটা তো খুব স্বাভাবিক কথা। এখানে গোলেমেলের কি আছে ? তারা তো ঐখানে বন্দুকের গুলি খেয়ে এসেছে, এখন ফিরে গেলে তাদের হত্যা করা হবে না, এই নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পেরেছে ? আপনি যদি এভাবে গুলি খেকে কোন মতে জান নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে আসতেন, সেই দেশের সরকার যদি আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে জোর করে ফিরিয়ে দিতে চাইতো, তবে আপনি কি করতেন, একবার নিজের হয়ে চিন্তা করে দেখুন।
৪র্থ প্রশ্নের উত্তর হলো, সেই সব ব্যানার ফেস্টুনে কি লেখা ছিলো ? বাংলাদেশের বিরোধী কিছু ?
নাকি ফিরে যাওয়া আকুতি ? যদি ফিরে যাওয়ার আকুতি হয়, তবে সেটা নিয়ে সন্দেহ খোজার কারণ কি ?
৫ম প্রশ্নের উত্তর হলো, মুহিবুল্লাহ’র আমেরিকায় যাওয়ায় বেআইনী কিছু পাওয়া যায়নি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেটা স্বীকার করেছে, সুতরাং এখানে আলগা চুলকানি হওয়ার কিছু নেই।
সত্যিই বলতে, আমি গুজব জিনিসটা খুব ভয় পাই। গুজব হচ্ছে মানুষের আবেগকে ব্যবহার করে হঠাৎ করে কিছু করে ফেলা, এবং একটি নির্দ্দিষ্ট মহল বিশেষ স্বার্থ হাসিলের জন্য জনগণকে দিয়ে কাজটি করিয়ে থাকে। তাই গুজব থেকে সাবধান। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, সঠিক অ্যানালাইসিস করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্যা সমাধান করুন। এবং অবশ্যই যেন তা জনগণের পক্ষে হয়।
আসুন এবার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে কিছু চিন্তা করি-
ক) গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুক ও মিডিয়ায় এমন কিছু খবর দেখছি, যা দেখলে রোহিঙ্গাদরে উপর মন বিষিয়ে উঠে। কথা হলো – হঠাৎ করে এই খবরগুলো কে ছাড়ছে ? তাদের উদ্দেশ্য কি ? আমরা বাংলাদেশীরা যদি রোহিঙ্গাদের উপর ক্ষেপে যাই, তবে লাভ হবে কার ?
কিছুদিন আগে পাহাড়ে এক সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা করে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। সেই ঘটনার পর বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- তার কাছে ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে, পাশ্ববর্তী দেশের (বার্মা) কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই কাজটা করেছে। তারা ইচ্ছা করে সেনাবাহিনী সদস্যকে হত্যা করেছে উস্কানি সৃষ্টির জন্য। এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশীরা যেন উপজাতিদের উপর ক্ষেপে যায়, এতে উপজাতিদের উপর ধরপাকড় হতে পারে। এতে পাল্টা উপজাতিদের মধ্যেও উত্তেজনা বিরাজ করবে। তখন সেই উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে পাশ্ববর্তী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো প্রচুর পরিমাণে বিদ্রোহী সদস্য সংগ্রহ করবে, যাদের দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের স্বশস্ত্র বিদ্রোহে কাজে লাগানো যাবে।
ঠিক একইভাবে যদি চিন্তা করি – বাংলাদেশীরা যদি রোহিঙ্গাদের উপর ক্ষেপে যায়, তার প্রতিদানে রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশের শত্রু হয়ে যাবে। যে রোহিঙ্গারা বার্মীজ সরকারের শত্রু ছিলো, তাদের শত্রুতার মাথা ঘুরিয়ে বাংলাদেশের দিকে দেয়া হবে। এই যে বিভিন্ন মিডিয়া বা ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে, এগুলো কিন্তু রোহিঙ্গারা দেখতেছে, তারা মিডিয়াও দেখে এবং ফেসবুকেও সক্রিয়। এই রোহিঙ্গারা কিন্তু বহু নির্যাতন সহ্য করে বাংলাদেশে এসেছে, তারা স্বজনের রক্তাক্ত লাশ ফেলে রেখে এসেছে, সমুদ্র সাতরে এসেছে, মৃত্যু কি তারা খুব কাছ থেকে দেখে দেখেছে। তারা খুব ডেসপারেট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সেই ক্রোধকে যদি আমরা কাজে না লাগিয়ে তৃতীয় পক্ষ কাজে লাগায় তবে সেটা কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি ।
একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুরু থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকা ঘাটি গাড়তে চেষ্টা করছে সম্রাজ্যবাদীরা। এছাড়া সাম্প্রতিক চীন-আমেরিকার যুদ্ধে প্রক্সিওয়ার জোন হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একদিকে চীন চাইছে বঙ্গপোসাগরে অবাধ উপস্থিতি, অপরদিকে ভারত-আমেরিকা চাইছে যেকান উপায়ে চীনের প্রভাব দূর করতে। এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী-কুতুবদিয়ার নিকবর্তী সমুদ্রে রয়েছে সম্ভাব্য বৃহৎ গ্যাসের মজুদ। এ অবস্থায় সম্রাজ্যবাদীদের খুব ইচ্ছা হবে, এ এলাকায় একটি বিদ্রোহী গ্রুপ তৈরী করে এ অঞ্চলে ডিস্ট্রার্ব করা। এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে বের করে আনা হয়েছে।
এটা মানতেই হবে, রোহিঙ্গারা সম্রাজ্যবাদীদের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি। তারা নিজেরাই নির্যাতিত এবং শিক্ষা ও নেতৃত্বের অভাবের কারণে অপরের দ্বারা ব্যবহৃত। তাদেরদের যারা বের করে এনেছে, তাদের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশীদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব লাগানো। কিন্তু এখনও রোহিঙ্গাদের শত্রুতার মুখ হচ্ছে বার্মীজ সরকারের দিকে। এটাকে ঘুরিয়ে বাংলাদেশের দিকে করানো হবে। এবং আমাদের বাংলাদেশীদের উত্তেজিত করে প্রথমে তাদের সাথে দ্বন্দ্ব ঘটানো হবে, এরপর তার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করানো হতে পারে, যার ভবিষ্যত আশঙ্কাগুলো আরো খারাপ।
তাহলে কি করা যেতে পারে ?
মুহিবুল্লাহ লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে এক করেছে, এটা তো খুব ভালো কথা, এটাকে খারাপ করে দেখার দরকার কি? এখন কথা হলো মুহিবুল্লাহ’র নিয়ন্ত্রণটা আমরা তৃতীয় কোন পক্ষের হাতে না দিয়ে আমরা বাংলাদেশীরা নিয়ে নেই, তাহলেই তো হয়। সে আমাদের আশ্রিত, আমি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে কেন তাকে আমার কেন দূরে ঠেলে দেবো, তাকে কেন তৃতীয় পক্ষের সাথে বন্ধুত্ব করতে দিবো ? আমি তার সাথে ভালো ব্যবহার করে তার নিয়ন্ত্রন আমি নিয়ে নেই। সে আমার আশ্রিত, তার উপর আমার অধিকার বেশি।
এতদিন বাংলাদেশীরা বিভিন্ন স্থান গিয়ে গিয়ে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কথা বলেছে। এখন মুহিবুল্লাহ নামক এক নেতা পাওয়া গেলো, তাকে আরো বুদ্ধি দিয়ে, সুযোগ বিশ্বজুড়ে ঘুড়িয়ে ফিরে রোঙ্গিাদের নিরাপদ প্রত্যাবসন এবং নাগরিক সুবিধা দেয়ার জন্য দাবী আদায় করা হোক। একজন রোহিঙ্গার মুখ থেকে রোহিঙ্গাদের দাবীর কথাগুলো শুনলে আরো ভালো হয় না? কিন্তু সেটা না করে আমরা মুহিবুল্লাহ নামে অমুক তমুক রটিয়ে তাকে খারাপ করার চেষ্টা করছি।
এ সম্পর্কে ইহুদীবাদী গোয়েন্দা মোসাদ বা সিআইএ’দের একটা কার্যক্রমের কথা মনে পড়লো। আগে কোন ব্যক্তি তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তাকে তারা গুপ্ত হত্যা করে মেরে ফেলতো। কিন্তু এখন তারা নাকি সেটা আরো ধিরে করে। এক্ষেত্রে-
প্রথমে চেষ্টা করে ঐ ব্যক্তিকে ঘুরিয়ে নিজের দলে ভেড়াতে,
যদি সেটা না হয়, এরপর চেষ্টা করে, তাকে ভীতি দেখিয়ে তার বিরোধীতা বন্ধ করতে,
এরপরও যদি না হয়, তখন শেষ স্টেপ হিসেবে তাকে হত্যা করা হয়।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বাংলাদেশীরা যখন মুহিবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে বলে ফেসবুকে শত শত স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তখন সমাবেশের মধ্যে এক শেতাঙ্গ নারী মুহিবুল্লাহ’র গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে, তার সাথে খাতির করছে। তখন আমি অবাক হলাম যে, ডিপ্লোমেটিক জ্ঞানে আমরা কতটা পিছিয়ে। যে মুহিবুল্লাহকে আমাদের ব্যবহার করার কথা, সেটা না করে আমরা উল্টা তাকে শত্রু হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছি, আর সুদূর ইউরোপ-আমেরিকার এজেন্টরা তার গলা ধরে তাকে বন্ধু বানাতে চাইছে, যাদের উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করা।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসলে আরো অনেক কিছু বলার আছে, অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে, সেগুলোও উত্তর দেবো। তাবে সবার আগে দরকার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে পুরো বিষয়টি বোঝা, তাহলে আমাদের পরবর্তী চিন্তাগুলো করতে সহজ হবে। সামনের লেখাগুলোতে তা বিস্তারিত লিখবো। (চলবে)
Image may contain: 3 people, people smiling, people standing and outdoor