গতকাল `বাংলাদেশ সময় সকালে’ আমি সম্ভবত একমাত্র ছিলাম, যে এই পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম। স্ট্যাটাস দেয়ার পর কমেন্টে অনেকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম, ‘পুরো ঘটনায় কোন বিশেষ সমস্যা আছে, কোন একটি বিশেষ মহলের স্বার্থ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।” বিষয়টি নিয়ে অনেকে আমার সাথে তর্কও করেছিলো, কিন্তু দিন গড়াতে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়েছে এবং সরকারও ইউটার্ন নিয়েছে।
১) আমি দেখছিলাম, সরকারের মধ্যে একটি মহল পুরান ঢাকার কেমিকেল কারখানার পেছনে আগেই লেগেছে, এটা সন্দেহজনক।
২) মিডিয়াতে মার্কিনপন্থী একটি গ্রুপ আগে থেকেই পুরান ঢাকার কেমিকেল কারখানা উচ্ছেদের পক্ষে। এই ঘটনায় তাদের পোয়াবারো হয়েছে।
৩) ইউটিউবের একটি ভিডিওতে দেখলাম, মার্কিনপন্থী একটি মিডিয়া ঢামেক মর্গের সামনে এক নিহতের আত্মীয়কে শিখিয়ে দিচ্ছে, “বলুন, আমরা পুরান ঢাকা থেকে সমস্ত কেমিকেল কারখান উচ্ছেদ চাই।”, নিহতের আত্মীয় সেটাই মুখস্ত বলছে, আর সেটা ভিডিও করে সারা বিশ্বে প্রচার করা হচ্ছে।
৪) ঘটনা ঘটার পর সাঈদ খোকন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ওবায়দুল কাদের এই তিনজনের মুখ থেকে মিডিয়া স্বীকৃতি নেয়ার চেষ্টা করে, পূরান ঢাকা থেকে কেমিকেল কারখানা উচ্ছেদ করা হবে।
৫) ঘটনা যদি এই পর্যন্ত ঘটতো, তবে যারা সচেতন মহল (অবশ্যই সাধারণ জনগণ নয়), তারা বুঝতে পারতো, ঘটনা ‘ডালমে কুছ কালা হে’, হাজার কোটি টাকার প্রডাকশন মার্কিনপন্থী একটি গ্রুপের প্রভাবে সরকার ডুবিয়ে দিচ্ছে, তাহলে কি এই ঘটনা স্যাবোটেজ ? দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে বিদেশী কর্পোরেটদের পথ পরিষ্কার করতে চায় তারা ?
৬) কিন্তু সরকার দুপুরের পর ইউটার্ন নেয়, বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য এবং তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আপনারা গতকাল সকালে যারা আমার কমেন্ট পড়েছেন, তারা বানিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে মিল পাবেন আশাকরি। আমি বলবো, সরকার এতে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে, নয়ত একদিন না একদিন পুরো ঘটনার দায় সরকারের উপর পড়তো।
৭) ইহুদীদের প্রোটোকলে সাধারণ জনগণকে তুলনা করা হয়েছে ভেড়ার পালের সাথে। গতকালকে ঘটনা ঘটার পর পাবলিকের লম্ফ-ঝম্ফ দেখে আমার তেমনটা মনে হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বোঝাই গাড়ি বিষ্ফোরণে, আর মার্কিনপন্থী মিডিয়ার প্রভাবে দায় চাপিয়েছে কেমিকেল কারাখানার উপর। অথচ ঐ এলাকায় কোন কেমিকেল কারখানা বা তার গোডাউন ছিলো না (শুধু সরকারের তদন্ত প্রতিবেদন নয়, আমি ফোনে পুরান ঢাকায় আমার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। তবে সেখানে অ্যালকোহল মিশ্রিত বডি স্প্রে’র গোডাউন এবং পলিমার দানার গোডাউন ছিলো)। ইহুদী প্রটোকলে এমনি এমনি জনগণকে ভেড়ার সাথে তুলনা করা হয় নাই।
৮) অনেকে বলেছে, “ভাই যাই হোক, তাই বলে এতগুলো প্রাণ ?” আরে ভাই, ভেড়ার যেমন কোন মূল্য নাই, তেমনি সম্রাজ্যবাদী ও তার দোসরদের কাছে জনগণেও কোন মূল্য নাই। যদি মূল্য থাকতোই তবে, সামান্য কিছু টাকার লোভে বিদেশীদের প্রেসক্রিপশনে সরকার দুই-আড়াই কোটি শিশু বাচ্চার মুখে ভিটামিন এ ক্যাপসুল নামক ওভার ডোজ ঔষধ তুলে দিতে পারতো ? জিএমও ফুড বা গোল্ডেন রাইস এনে কোটি কোটি মানুষকে ক্যান্সারের দিকে ঢেলে দিতে পারতো ? একটা কথা মনে রাখবেন, ইহুদীবাদী কর্পোরেটরা বুঝে ব্যবসা আর টাকা আর সরকার বুঝে তার কমিশন। হাজার না লাখ ভেড়ার জান গেলো, এটা তাদের দেখার বিষয় না। তাই সব সময় বলি কর্পোরেটোক্রেসির উপর লেখাপড়া করেন, অনেক কিছু বুঝতে পারবেন।
৯) গতকালকে অনেক পাবলিককে স্ট্যাটাস দিতে দেখেছি, তারা বলছে পুরান ঢাকার জনগণ বোমা’র উপরে বসবাস করে। হায়রে বোকা ! শুধু পুরান ঢাকার জনগণ কেন ? পুরো বাংলাদেশের মানুষের ঘরে এখন বোমা পাঠানো হচ্ছে। সরকার বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়াতে বাসায় বাসায় এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের চাহিদা বাড়ছে। আর এলপি গ্যাস সিলিন্ডার মানে এক একটি বোমা। আপনি পুরান ঢাকার কয়েক লক্ষ জনগনকে নিয়ে কাদছেন, আর সারা দেশে কোটি কোটি জনগণ আর বোমার হুমকির মধ্যে, সেটা নিয়ে তো কাদলেন না ? পুরান ঢাকায় এলপি সিলিন্ডার বোঝাই গাড়ি বিষ্ফোরণের পর জনগণের উচিত ছিলো এই সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, কিন্তু জনগণ ক্ষেপে গেছে কেমিকেল কারখানার উপর। আহ ! কি দুঃখ !!
১০) আমিও ব্যক্তিগতভাবে পুরান ঢাকার কেমিকেল কারখানা সরিয়ে নেয়ার পক্ষপাতি। আমি সব সময় ঢাকা বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে বলি। এই বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হচ্ছে ঢাকার এইসব শিল্প কারখানা ঢাকার বাইরে কোন জেলায় নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এরমানে এই নয়, তিলে তিলে গড়ে ওঠা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানকে কোন স্যাবোটেজ করে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হবে। আগে যেখানে পাঠাবেন, সেখানাকার ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করুণ, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিন, তারপর তাদের পাঠান। চামড়ার ট্যানারিদের যেভাবে গলা ধাক্কা দিয়ে সাভারে খালি ময়দানে পাঠিয়ে চামড়া শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবেন না। হুজুগে পড়ে কারো তিলে তিলে গড়ে ওঠা ব্যবসায় লাথি মারা মানে ঐ লোকগুলোর উপর অবিচার করা, এটাও মেনে নেয়া যায় না।
১১) সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, পুরান ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের কেমিকেল কারখানাগুলো এক করে কেরানীগঞ্জের কেমিকেল পল্লীতে আনা। কেরানীগঞ্জে আনা মানে তো, সেই ঢাকা কেন্দ্রীক করা, বিকেন্দ্রীকরণ তো হলো না। কেরাণীগঞ্জ না করে এই কেমিকেলপল্লী শরীয়তপুর, মাদারিপুর বা অন্যকোন জেলা শহরে করা যেতে পারে। তাছাড়া কেরানীগঞ্জে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৩০০ প্লট, এটাও কম। হাজার হাজার ব্যবসায়ীর জন্য আরো বড় যায়গা বরাদ্দ করা দরকার ছিলো।
১২) এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে “গ্যাস সিলিন্ডার একটি একটি বোমা, এই বোমা বাসাবাড়িতে পাঠানো বন্ধ করুন”” এই শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তুলুন। শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে সংসদে দাড়িয়ে বলেছিলো, “বাসাবাড়িতে সরকার আর কোনো গ্যাস সংযোগ দেবে না। এটা ফাইনাল। এখন সরকারি যত ফ্ল্যাট আছে সেখানে এলপিজি স্টোরেজ বানানো হবে। সেখান থেকে লাইন দেয়া হবে। বাসাবাড়িতেও এই পদ্ধতি চালু হবে।” (http://www.somoyerkonthosor.com/2018/05/21/226072.htm)
এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। বলুন, এলপিজি স্টোরেজ নামক বোমার কারখানা না বানিয়ে জাতীয়ভাবে গ্যাস সংযোগ দিতে হবে।" একই সাথে বলুন, বিদেশ থেকে এলএনজি আমাদিন করে জাতীয় গ্রিডে সংযোগ দিয়েও লাভ হবে না। এতে বাংলাদেশের জনগণের জীবন খরচ বেড়ে যাবে। এর বদলে সরকার যেন গ্যাস উত্তোলন শুরু করে। আন্তর্জাতিক চাপে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ রাখার পলিসি থেকে সরকার যেন সরে আসে। “গ্যাসের উপর ভাসছে দেশ”, যেই দেশে “সমুদ্র তলদেশে ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ : বাংলাদেশ হবে আগামীর এনার্জি সুপার পাওয়ার”, আছে বলে দ্য ডিপ্ল্যোম্যাটে সংবাদ আসে, সংবাদ আসে, সেই দেশের মানুষ পাইপে গ্যাস না পেয়ে এলপি সিলিন্ডার বহণ করতে গিয়ে বিষ্ফোরণে মারা যায়, তা সত্যিই দুঃজনক।
এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। বলুন, এলপিজি স্টোরেজ নামক বোমার কারখানা না বানিয়ে জাতীয়ভাবে গ্যাস সংযোগ দিতে হবে।" একই সাথে বলুন, বিদেশ থেকে এলএনজি আমাদিন করে জাতীয় গ্রিডে সংযোগ দিয়েও লাভ হবে না। এতে বাংলাদেশের জনগণের জীবন খরচ বেড়ে যাবে। এর বদলে সরকার যেন গ্যাস উত্তোলন শুরু করে। আন্তর্জাতিক চাপে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ রাখার পলিসি থেকে সরকার যেন সরে আসে। “গ্যাসের উপর ভাসছে দেশ”, যেই দেশে “সমুদ্র তলদেশে ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ : বাংলাদেশ হবে আগামীর এনার্জি সুপার পাওয়ার”, আছে বলে দ্য ডিপ্ল্যোম্যাটে সংবাদ আসে, সংবাদ আসে, সেই দেশের মানুষ পাইপে গ্যাস না পেয়ে এলপি সিলিন্ডার বহণ করতে গিয়ে বিষ্ফোরণে মারা যায়, তা সত্যিই দুঃজনক।
সবশেষে বলবো, অনেকে গতকাল কমেন্ট করেছেন, “ভাই আপনার লেখা খুব ভালো লাগে, কিন্তু এ বিষয়টি ভালো লাগলো না”, তাদের উদ্দেশ্য করে বলবো, ভাই আমার সব কথা যে আপনাদের ভালো লাগবে, এটা আমি মনে করি না। আমার অনেক লেখা আপনাদের খারাপ লাগবে এটা বরং আমি মনে করি। কিন্তু কারো ভালো লাগবো, আর কারো খারাপ লাগলো, এই চিন্তা করে আমি লেখালেখি করতে চাই না। কারণ যদি আমি এ কথা চিন্তা করি, তবে আমি অনেক সত্য প্রকাশ করতে পারবো না। আপনারা কি চান, আমি কারো মন জুগিয়ে সত্য প্রকাশ থেকে সরে আসি ? নয়নের কাজ নয়ন খোলা, তাই একটু কষ্ট লাগলেও সত্যটা সহ্য করতে হবে। ধন্যবাদ।