চকবাজারে আগুনের মূল কারণ ‘ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন’
নিমতলী আর চকবাজার এই দুই অগ্নিকাণ্ডের মাঝের তফাৎ ছিলো ১টি মাত্র বিষয়। সেটা হলো ‘কেমিকেল ট্রেড লাইসেন্স’। ২০১০ সালে নিমতলীর ঘটনার অজুহাতে ২০১৩ থেকে আর কোন ব্যবসায়ীকে কেমিকেল ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়নি, কিন্তু ব্যবসায়ীদের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে অবশেষে সরকার ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে আবার ফিরে আসে। এবং আগুন লাগার মাত্র ১ দিন আগে ৫টি কোম্পানিকে ট্রেডলাইসেন্স নবায়ন করে দেয়। দীর্ঘ ৬ বছর পর ট্রেড লাইনেন্স নবায়ন শুরু করার পরের দিনই অর্থাৎ ২০শে ফেব্রুয়ারী আগুন লাগে এবং আবারও কথিত কেমিকেল বিরোধী সেন্টিমেন্ট ছড়িয়ে দেয়া হয়। (https://bit.ly/2VpCUEf, https://bit.ly/2BVFZ7u)
এ সংবাদটি বলে দিচ্ছে, চকবাজারের আগুনের সেন্টার পয়েন্ট হচ্ছে, কেমিকেল লাইসেন্স নবায়ন। কোন একটি গোষ্ঠী চাইছে না, কেমিকেল ব্যবসা থাকুক। যেই লাইসেন্স নবায়ন শুরু হলো, আবার আগুন লাগিয়ে সেটা বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু কথা হলো, এতে ঐ গোষ্ঠীর লাভ কি ?
কেমিকেল ব্যবসায় লাইসেন্স না দেয়ায় ২০১৮ সালে অগাস্টে কেমিকেল ব্যবসায়ীরা মতিঝিলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলো, “কেমিকেল সম্পর্কে ভুল রটানো হচ্ছে। প্রত্যেকটি কারখানায় কেমিকেল প্রয়োজন হয় এবং সব কেমিকেলই দাহ্য নয়। কিন্তু রটানো হচ্ছে সব কেমিকেল খারাপ। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য সবকিছুর মধ্যে কেমিকেল আছে। ”(https://bit.ly/2Ex5sFX)
এ খবর দ্বারা ব্রডওয়েতে একটা কথা বলা যায়, যারা চায় না বাংলাদেশে কেমিকেল ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স পাক, আসলে প্রকৃতপক্ষে তারা চায় না পুরান ঢাকায় কোন কারখানা চলুক বা প্রডাকশন বা উৎপাদন হোক।
উৎপাদন বা প্রডাকশন কি ? কেন বিদেশী বহুজাতিকরা বাংলাদেশে প্রডাকশন বিরোধী ??
একটা ডিম, একটু তেল, একটু আটা মিলে হচ্ছে একটা কেক। ডিম, কেক আর আটার সব মিলিয়ে খরচ ১০ টাকা। কিন্তু একটা কেকের দাম ৩০ টাকা। এই যে ১০ টাকাকে ৩০ টাকায় রূপান্তর করা হলো, এইটা হলো প্রডাকশন বা উৎপাদন।
ধরুন, বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস পাওয়া গেলো। এই গ্যাস রফাতানি করা কি লাভজনক ?
না, কোন র’ ম্যাটেরিয়াল রফতানি করা লাভজনক নয়। ঐ গ্যাস দিয়ে যদি বিদ্যুৎ তৈরী করে, সেই বিদ্যুৎ রফতানি করা হয়, তবে লাভ অনেক বেশি হবে। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরীকে আমরা বলছি প্রডাকশন বা উৎপাদন।
না, কোন র’ ম্যাটেরিয়াল রফতানি করা লাভজনক নয়। ঐ গ্যাস দিয়ে যদি বিদ্যুৎ তৈরী করে, সেই বিদ্যুৎ রফতানি করা হয়, তবে লাভ অনেক বেশি হবে। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরীকে আমরা বলছি প্রডাকশন বা উৎপাদন।
বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিদেশ যায়। এই শ্রমিক পাঠানো কি লাভজনক ?
না। এই শ্রমিকদের ট্রেনিং দিয়ে, কোন দেশী কোম্পানির আন্ডারে দেয় হয় এবং তারপর ঐ কোম্পানিকে যদি রফতানি করা হয়, তবে এর মাধ্যমে আরো বহুগুণ লাভবান হওয়া সম্ভব। র’ শ্রমিক থেকে কোম্পানি বানানোটা এক ধরনের প্রডাকশন বা উৎপাদন।
না। এই শ্রমিকদের ট্রেনিং দিয়ে, কোন দেশী কোম্পানির আন্ডারে দেয় হয় এবং তারপর ঐ কোম্পানিকে যদি রফতানি করা হয়, তবে এর মাধ্যমে আরো বহুগুণ লাভবান হওয়া সম্ভব। র’ শ্রমিক থেকে কোম্পানি বানানোটা এক ধরনের প্রডাকশন বা উৎপাদন।
অর্থাৎ কোন র’ মেটেরিয়াল রফতানি করা লাভজনক নয়, বরং সেই র’মেটেরিয়াল দিয়ে কোন প্রডাক্ট বা সিস্টেম বানিয়ে সেটা রফতানি করলে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যায়। এই জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন র’ মেটেরিয়াল রফতানির পক্ষে নই।
আবার আমদানির ক্ষেত্রে ঠিক উল্টা। মানে র’ মেটেরিয়াল আমদানি বা সংগ্রহ করে যদি আমরা নিজেরা কোন প্রডাক্ট তৈরী করতে পারি তবে খরচ অনেক কমানো সম্ভব এবং সেটাই লাভজনক। একাধিক র’ মেটেরিয়াল এক করে যারা নতুন প্রডাক্ট তৈরী করতে পারে, তাদের বলে কারিগর। পুরান ঢাকায় বর্তমানে এমন অনেক কারিগর তৈরী হয়েছে, যারা দুই-চারটা প্রডাক্ট এক করে নতুন প্রডাক্ট তৈরী করতে পারে বা প্রডাকশন করতে পারে। এই সকল কারিগরের কারণে আমরা অনেক খরচ থেকে বেচে যাই, যা আমরা নিজেরাই জানি না। উদাহরণ স্বরূপ, পুরান ঢাকায় অসংখ্য রং এর অনেক দোকান আছে। এরা ৩-৪টা কেমিকেল মেটেরিয়াল এক করে ব্যবহার্য রং তৈরী করতে পারে। ধরেনিলাম, পুরান ঢাকা থেকে ১ পাউন্ড রং বানানোর পর বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। কিন্তু বিদেশ থেকে তৈরীকৃত সমপরিমাণ রং এর দাম পড়তো ১ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে উৎপাদন বা প্রডাকশনের কারণে ৯০০ টাকা সেভ হচ্ছে। এতে জনগণও কমমূল্যে জিনিস পাচ্ছে আবার অনেক লোকেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে। আজকে ফেসবুক-অনলাইনে যে অতি উৎসাহি সমাজ কেমিকেল কারখানা গুদাম সরাও, সরাও বলে চিৎকার করছে, আমার ধারণা- তারা নিজেরাও জানে না, তার দৈনন্দিন ব্যবহার্য অনেক কিছুই আসে পুরান ঢাকার সেস কারখানা থেকে। এসব উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে তাকে অনেক কিছুর জন্যই বিদেশ নির্ভর হতে হবে এবং এ কারণে তার জীবনব্যয় কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে।
শেষে শুধু একটা কথাই বলবো-
নিমতলীর ঘটনার পর লাইসেন্স নবায়ন না হলেও পুরান ঢাকা থেকে কিন্তু কেমিকেল সরে নাই। বৈধ-অবৈধ যেভাবেই হোক তারা ব্যবসা চালিয়ে গেছে। এই সময় কিন্তু কোন অগিকাণ্ডও হয় নাই। কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন শুরু করার মাত্র ১দিন পর আবার অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে, আগুনের পেছনে কেমিকেল বা সিলিন্ডার কোনটাই দায়ী নয়, আসল দায়ী হলো, একটা মহল, যারা চায় না কেমিকেল লাইসেন্স নবায়ন করা হোক।
এভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে এতগুলো জীবন কেড়ে নেয়াকে কখন সমর্থন করা যায় না। তাই এতগুলো নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার জন্য পর্দার অন্তরালে থাকা খুনি ও তাদের প্রকাশ্য সহযোগীদের বিচার দাবী করছি।
নিমতলীর ঘটনার পর লাইসেন্স নবায়ন না হলেও পুরান ঢাকা থেকে কিন্তু কেমিকেল সরে নাই। বৈধ-অবৈধ যেভাবেই হোক তারা ব্যবসা চালিয়ে গেছে। এই সময় কিন্তু কোন অগিকাণ্ডও হয় নাই। কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন শুরু করার মাত্র ১দিন পর আবার অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে, আগুনের পেছনে কেমিকেল বা সিলিন্ডার কোনটাই দায়ী নয়, আসল দায়ী হলো, একটা মহল, যারা চায় না কেমিকেল লাইসেন্স নবায়ন করা হোক।
এভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে এতগুলো জীবন কেড়ে নেয়াকে কখন সমর্থন করা যায় না। তাই এতগুলো নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার জন্য পর্দার অন্তরালে থাকা খুনি ও তাদের প্রকাশ্য সহযোগীদের বিচার দাবী করছি।
বি:দ্র: একটি ঘটনা থেকে একেক জন একেক রকম ফায়দা নিতে পারে। পুরান ঢাকার কারখানার প্রডাকশন বন্ধ হলে অনেক বাসাবাড়ি খালী হবে। ফলে সেসব বাসাবাড়ি ভেঙ্গে সেখানে পর্যটন ব্যবসা করবে আরেকটি মহল, সেই ব্যবসার জন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করবে। তারপর সেখান থেকে কমিশন লাভবান হবে।