লজ্জা, লাজ, শরম, হায়া, শালীন
লজ্জা শব্দটা নিয়ে আমি মাঝে মাঝে গবেষণা করি। সভ্য সমাজের মানুষের লজ্জা আছে, তাই তারা কাপড় পড়ে। বন-জঙ্গলে অনেক জাতি বাস করে, ওদের জংলী বলে, তারা কাপড় পড়ে না। তাদের লজ্জা-শরম নেই !
প্রবাদ আছে, “ন্যাংটার নাই বাটপারের ভয়”। প্রবাদের মর্মার্থ, লজ্জাহীনের কাছে কোন সম্পদ নাই, তাই তার কাছে চিটার-বাটপার যায় না। অপরদিকে লজ্জাশীলের কাছেই সম্পদ, তাই তার কাছে চোর-বাটপার যায়।
প্রবাদ আছে, “ন্যাংটার নাই বাটপারের ভয়”। প্রবাদের মর্মার্থ, লজ্জাহীনের কাছে কোন সম্পদ নাই, তাই তার কাছে চিটার-বাটপার যায় না। অপরদিকে লজ্জাশীলের কাছেই সম্পদ, তাই তার কাছে চোর-বাটপার যায়।
লজ্জা সম্পর্কে একের ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গী একেক রকম। হিন্দু ধর্মে লজ্জা শব্দটা নিয়ে একটা দেবী আছে। নাম- ‘লজ্জা গৌরী’, উইকিপিডিয়া মতে, “এই দেবীকে উর্বরতা ও প্রাচুর্যের দেবী রূপে বিশ্বাস করা হয় এবং তাঁকে লজ্জার অভিব্যক্তি হিসেবে বর্ণিত করা হয়েছে।” সমস্যা হলো উক্ত দেবীর মূর্তি দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। হিন্দু ধর্মমতে লজ্জাদেবীর যদি এই অবস্থা হয়, তবে বাকিদের কি অবস্থা হবে ? (লজ্জা গৌরীর ছবি দেখতে-https://bit.ly/2RYQEbz, https://en.wikipedia.org/wiki/Lajja_Gauri)
ইসলাম ধর্মেও লজ্জা শব্দের ব্যাপক ব্যপ্তি আছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, “লজ্জা হচ্ছে ঈমানের (ঈমান=বিশ্বাস) অঙ্গ, যার লজ্জা নাই তার ঈমান নাই।” এজন্য মধ্যযুগীয় সাহিত্যে হিন্দু নারী ও মুসলিম নারীর মধ্যে বাক্য চয়নে পার্থক্য দেখা যায়। মুসলিম নারীর ক্ষেত্রে সাহিত্যিক সব সময় লিখতো- সম্ভ্রান্ত মুসলিম মহিলা, হিন্দু নারীর ক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত শব্দখানার ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। হিন্দুরা নারীরা যেখানে ব্লাউজ ছাড়া থাকতো, সেখানে মুসলিম নারীরা লম্বাহাতা ব্লাউজ পড়তো।
লজ্জা শব্দটা নিয়ে ঘাটতে ঘাটতে দেখলাম, বাংলাদেশের মুসলিম নারীদের সেই ‘লজ্জা’ শব্দটা ভাঙ্গতে একটা মহল বেশ সক্রিয়। তারা বার বার বিভিন্ন উপায়ে নারীদের আহবান করছে লজ্জা ভুলে যেতে। তাদের দৃষ্টিতে নারীর লজ্জা হচ্ছে সমাজের বাধন। তাই তারা সেই বাধনের গিটে গিটে বার বার আঘাত করছে। আসুন সেরকম কিছু আঘাতের দৃশ্য দেখি-
(১) সফটি স্যানিটারি ন্যাপকিন: কাদিয়ানী কোম্পানি আরএফএল’র সফটি স্যানিটারি ন্যাপকিন একটি বিজ্ঞাপন ছেড়েছে ফেসবুকে যার শ্লোগান-“পিরিয়ড অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে লজ্জা নয়।” বিজ্ঞাপনের ভেতর বলা হচ্ছে, সবাইকে আহবান করা হচ্ছে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে। এবং বলা হচ্ছে আপনার পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা সমাজের মধ্যে বিষয়টিকে স্বাভাবিক করে তুলবে। তারা একটি হ্যাশট্যাগও ছাড়ছে #TalkPeriod
(২) নারীদের অন্তর্বাস নিয়ে নাটক: নারীদের অন্তর্বাস নিয়ে আলোচনা স্বাভাবিক করার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলো সাজু খাদেম নামক এক ভাড়। একটি ফানি রিয়েলিটিশোতে সে কয়েকজন মেয়েকে একত্র করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “মেয়েরা…. উপর যেটা পড়ে সেখানে বরিশালে কি বলে?, মেয়েরা উত্তর না দিতে পারলে সাজু বলে, “‘ব্রা’ বলে।” (https://youtu.be/lXw93DdRn8U),
অনুষ্ঠানে বিষয়টি সেন্সর করা হলেও পরবর্তীতে তা কাট করে ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। বর্তমানকালে বিষয়টি ফের তুলে নিয়ে এসেছে ন্যাটকার সিআইএ’র এজেন্ট মোস্তাফা সারোয়ার ফারুকীর সাগরেদ মাবরুর রশিদ বান্নাহ। সে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আইফ্লিক্স এ ব্রা-দার নামক নাটক করে নারীদের অন্তর্বাস নিয়ে আলোচনা সহজ করতে চায়। নাটকটির মধ্যে মেয়েদের অন্তর্বাসের সাইজ নিয়ে রঙ্গ করা হয়, যদিও সেটা প্রকাশ্যে করলে তা যৌন হয়রানী বা অপরাধ বলে গন্য করা হয়।
(https://youtu.be/wiBSOg-B6SU)
(https://youtu.be/wiBSOg-B6SU)
(৩) নারীদের শরীরের মাপ নিয়ে সবচেয়ে সহজ করে দিয়েছে সানাই নামক একটি মেয়ে। সে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করার পর সব মিডিয়া তাকে নিয়ে গণহারে নিউজ করে বিষয়টি লাইমলাইটে নিয়ে আসে। ফলে ‘নারীর বুকের সাইজ’ নিয়ে আলোচনা করা যেন এখন ডাল-ভাত।
(৪) নারীদের লজ্জা ভুলতে হবে, এই কথাটা কয়েকদিন আগে বেশ স্পষ্ট করেছে শাহনাজ আক্তার নামক এক নারী বাইক রাইডার। এই মহিলার কথিত বাইক চুরির ঘটনাকে পূজি করে প্রথমে তাকে ভাইরাল করা হয়। এরপর সে লাইমলাইটে আসার পর বিবিসি তাকে দিয়ে এক সাক্ষাৎকার বানায়। যেখানে শাহনাজ আক্তার নারীদের লজ্জা ভুলে যেতে বলে। (https://youtu.be/5cOtJHLWNEI)
জানি না, আপনাদের কাছে কোন ঘটনা বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে কি না, কিন্তু আমি দেখছি, কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন অংশ থেকে একই শ্লোগান উঠছে, “হে বাংলাদেশের মুসলিম নারী, তুমি লজ্জা ভুলে যাও”।
আজকে যে বহিরাগত সমাজটি চাচ্ছে, বাংলাদেশে নারীদের লজ্জা উঠে যাক, হতে পারে তাদের দেশে নারীদের লজ্জা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নারীদের লজ্জা উঠে গেলে কি সমস্যা হতে পারে ? আজকে সবাই ফেসবুকে দেখেছেন, থ্রি-ডক্টরস একাডেমীর এক ডাক্তার তার নিলর্জ্জ স্ত্রী’র লজ্জাহীনতা সহ্য না করতে পেরে নিজে আত্মহত্যা করেছে। এখান থেকে একটি সূত্র পাওয়া যায়, বাংলাদেশের সমাজ কিন্তু নিলর্জ্জ নয়, কিন্তু সমাজের অংশ নারী যদি নিলর্জ্জ হয়, তবে পুরো সমাজ হুমকির মুখে পড়ে, তখন জীবন দিয়ে তাকে তার প্রতিদান দিতে হয়। তাই নারীর লজ্জাহীনতা আর সমাজের আত্মহত্যা একই কথা।