চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ’

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ’ 
Image result for নদী
চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ’ (আইইবি)। এই তদন্ত প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে কথা বলবো। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে,
“ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় প্রসাধনী সামগ্রী মজুদ ছাড়াও খালি ক্যানে পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার রিফিল করা হতো। এগুলো উদ্বায়ী ও দাহ্য পদার্থ। পারফিউমের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে প্রোপিল্যান্ট (Propellant) হিসেবে এলপিজি ব্যবহৃত হয়। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘনত্ব আনুমানিক শতকরা একভাগ হলেই তা দাহ্যতার নিম্নসীমা অতিক্রম করে এবং স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতিতে আগুন ধরে বিস্ফোরণ হতে পারে। এলপিজি সাধারণত নিচু ও বন্ধ জায়গায় জমা হয়। জমাটবাধা এলপিজি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসামাত্র ফ্ল্যাস ব্যাকের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।” (https://bit.ly/2tRpzc1)
ভালোভাবে রিপোর্টটা খেয়াল করুন, রিপোর্টে প্রথম যে বিষ্ফোরণ হলো, সেটার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, এলপিজি গ্যাসকে, যা যে কোন পারফিউমের বোতলে ‘প্রোটিল্যান্ট’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন ভালোভাবে খেয়াল করুন, সেখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, “এলপিজি সাধারণত নিচু ও বন্ধ জায়গায় জমা হয়। জমাটবাধা এলপিজি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসামাত্র ফ্ল্যাস ব্যাকের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।”
কি বুঝলেন ?
এলপিজি বলতে এখানে বুঝাচ্ছে বিউটেন’কে। আমরা বাসাবাড়িতে যে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছি, এটাও কিন্তু এলপিজি বা বিউটেন। সরকারীভাবে যে প্রাকৃতিক গ্যাস লাইনে আসে, সেটা হলো মিথেন গ্যাস। মিথেন গ্যাস তুলনামূলক হালকা, এটা সামান্য একটু জানলা খোলা পেলেই উড়ে যায়। কিন্তু বিউটেন গ্যাস তুলনামূলক ভারি। আমরা বাসাবাড়িতে যে সিলিন্ডার ব্যবহার করছি, সেটা যদি কোন কারণে লিক হয়ে যায়, অথবা কেউ অসাবধানতাবশত গ্যাসের চুলায় গ্যাস ছেড়ে দেয় তবে তা উড়ে না গিয়ে জানালা দিয়ে বের না হয়ে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে জমা হতে থাকে। ফলে সেই গ্যাস জমে থাকার মধ্যে কেউ যদি ম্যাচের কাঠি জ্বালায় তবে পুরো ঘরের মধ্যে বিষ্ফোরণ ঘটবে, যেটা ঘটেছে ওয়াহিদ ম্যানসনের দুইতলায়।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা বাসাবাড়িতে আর গ্যাস সংযোগ দিতে নিষেধ করেছে এবং এলপিজি গ্যাস ব্যবহারে সবাইকে অভ্যস্থ হতে বলেছে (https://bit.ly/2XEqI4n)। কেউ নিজের ঘরে এলপিজি সিলিন্ডার নিতে পারে, আবার অনেক ফ্ল্যাট বাড়ির নিচে এলপিজি স্টোরেজ বানাবে, সেখানেই গাড়ি এসে গ্যাস দিয়ে যাবে। এসব ক্ষেত্রে যেটা হবে, ঘরের ভেতর রাখা এলপিজি বিষ্ফোরণ ঘটলে শুধু ঐ বাড়িটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু বাড়ির নিচে যে বড় স্টোরেজ বানানো হবে, সেটাতে যদি কোন কারণে বিষ্ফোরণ ঘটে তবে পুরো এলাকা উড়ে যাবে।
তারমানে সরকার আবাসিক এলাকার অজুহাতে পুরান ঢাকার দাহ্য (flammable) পর্দাথ অপসারণ করতে বলছে, কিন্তু নিজেই বাসাবাড়িতে বিষ্ফোরক (explosive)
এবং বিষ্ফোরক গুদাম বানাচ্ছে। বিষয়টা কি সম্পূর্ণ দ্বিচারিতা হয়ে গেলো না ??
আসলে এসব দাহ্য-আগুন কিছু না। ছোটবেলায় গল্পে পড়েছিলাম, “হরিণ বাঘকে বলেছিলো, আমি তো তোমার পানি ঘোলা করিনি, তবে আমাকে খাবে কেন ?” উত্তরে বাঘ বলেছিলো, “তুই ঘোলা করিসনি তো কি হয়েছে, তোর বাপ-দাদা তো ঘোলা করেছিলো। ” সরকারের মাস্টার প্ল্যান পুরান ঢাকায় ৪শ’ বছর ধরে গড়ে ওঠা দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যগুলোকে ধ্বংস করবে, সেটা যে অজুহাতেই হোক।
সরকারের সেই ইচ্ছাটাই কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে কৌশলে শেষে জোড়া দেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, “পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু এবং সড়কগুলো যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। এই এলাকার বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া।”
এটা হলো সরকারের অভ্যন্তরীণ প্ল্যান, যাকে বলা হচ্ছে, “আরবান ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট” প্রকল্প, অর্থাৎ পুরান ঢাকার বাড়িঘরগুলো ভেঙ্গে আবার নতুন করে গুলশান-বনানীর মত করে পরিকল্পিত এলাকা তৈরী করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মেয়র সাঈদ খোকন দু’বছর ধরে কাজ করছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না।
ব্যক্তিগতভাবে আমিও এ প্রকল্পের সরাসরি বিরুদ্ধে নই, কিন্তু শর্ত হলো পুরান ঢাকায় যে দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যগুলো ৪শ’ বছর ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে, সেগুলোর উচ্ছেদ না করে সঠিক পুনর্বাসন করে আগে অন্যত্র যায়গা দিতে হবে এরপর উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে তাদের ঋণ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। কিন্তু সরকার সম্ভবত সেটা চায় না। সরকার চায়, পুরান ঢাকায় ৪শ’ বছর ধরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসকল শিল্প ও বাণিজ্যগুলোকে আবাসিক এলাকা ট্যাগ দিয়ে উচ্ছেদ করতে এবং ধ্বংস করতে। ধরে নিলাম, পুরান ঢাকা রিডেভেলপমেন্ট করলে নদীর পাড়ে স্বাস্থ্য সচেতন একটি সুন্দর আবাসিক এলাকা গড়ে উঠবে, কিন্তু এইসব দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যের সাথে যে কোটি কোটি লোকের পেট-রুজি জড়িত তাদের কি হবে ? তাদেরকে কে কর্মসংস্থান দিবে ? কে খাবার দিবে ? বেগুনবাড়ি বস্তি ভেঙ্গে হাতিরঝিল বানানো যায়, দেখে প্যারিস, লস অ্যাঞ্জেলস বা হলিউড মুভির আনন্দও নেয়া যায়, কিন্তু বেগুনবাড়ি বস্তি উচ্ছেদের পর সেই দরিদ্র পরিবারটি কোথায় আছে, তার ছোট্ট শিশুটি না খেতে পেয়ে, চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছে না বেচে আছে, সেটার খবর রাখা সত্যিই দূরুহ ব্যাপার।
নিউইয়র্ক টাইম যখন চুড়িহাট্টা নিয়ে খবর করে, তার হেডিং ছিলো, “ধনীদের লোভের আগুনেই পুড়েছে চকবাজার : নিউইয়র্ক টাইমস” (https://bit.ly/2C0iVo3)।
খবরের ভেতরে তারা ‘ধনী ব্যবসায়ী’ টার্মটা ব্যবহার করছে।
আপনারা জানেন, ব্রিটিশরা যখন এ অঞ্চলে আসলো তখন তারা প্রথমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে এ অঞ্চলের ধনী মুসলমানদের থেকে সম্পত্তিগুলো কেড়ে নিয়েছিলো। কারণ তারা জানতো, সমাজে যদি ‘ধনী’ শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকে, তবে সেই সমাজে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব না। ঠিক একইভাবে এ অঞ্চলে ক্ষমতা পুরোপুরি হাতে নিতে সম্রাজ্যবাদী কর্পোরেটরাও একই উপায়ে এ অঞ্চলের ধনী তথা ধনী ব্যবসায়ীদের ফেলে দিতে চায়। (শুধু টিকে থাকবে গুটি কয়েক, যারা তাদের আজ্ঞাবহ ও গোলাম হয়ে থাকবে, যেভাবে ব্রিটিশ আমলে হিন্দু জমিদাররা ছিলো)।
সেই ধনী ব্যবসায়ীদের শেষ করার প্রক্রিয়ায় গতকাল মিডিয়ায় দেশের ৪টি শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকায় আগুনের খবর দেখলাম:
১) আশুলিয়ায় ঝুট গোডাউন ও সুতার কারখানায় আগুন (https://bit.ly/2SNmd3W)
২) সিদ্ধিরগঞ্জে কারখানায় আগুন। (https://bit.ly/2TvQIj0)
৩) মিরপুর শপিং সেন্টারে আগুন (https://bit.ly/2EDsiLg)
৪) কারওয়ান বাজার গোডাউনে আগুন (https://bit.ly/2SM9H4o)
এজন্যই আমি ২ বছর ধরে আপনাদের সতর্ক করতেছিলাম, বলেছিলাম খুব শিঘ্রই বাংলাদেশে কর্পোরেটোক্রেসি’র বড় রূপ আসতেছে। দেশের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হবে, বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর আগমণ হবে, তাদের সুবিধার জন্য আগে থেকেই জনগণের টাকায় বড় বড় আবকাঠামো নির্মাণ হবে, ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের জীবন ব্যয় বেড়ে যাবে, বাড়িভাড়া আর খাবার খরচ যোগাতে ঘরের বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানিতে নামমাত্রমূল্যে দাস হবে। একটা জাতিকে চিরস্থায়ী দাসে পরিণত করতে যে প্ল্যান তাকেই বলে ‘কর্পোরেটোক্রেসি’, যার মূল প্ল্যান ইহুদীবাদী কর্পোরেটদের, আর ফিল্ডে বাস্তবায়ন করে ঐ দেশের সরকার।