বিশ্বাস ও যুক্তি-প্রমাণ, কোনটা কোথায়?এন.সি- ৩৬৩

বিশ্বাস ও যুক্তি-প্রমাণ, কোনটা কোথায়?

Image result for সাগর
বিশ্বাস ও যুক্তি-প্রমাণ, কোনটা কোথায়?
আস্তিকরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী, নাস্তিকরা সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী। ধর্মের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। ধর্মে যা বলা আছে, একজন ধার্মীক তা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে, এটা নিয়ে তার দ্বিমত নেই। ধর্মের সাথে বিশ্বাস শব্দটা যুক্ত। ধার্মীকরা বিশ্বাস দ্বারা আবদ্ধ দেখে, তাদের অনেক কথা শুনতে হয় নাস্তিক ও সমমনাদের থেকে। তারা ধর্মকে অন্ধ বিশ্বাস, কুপমণ্ডুকতাসহ নানান শব্দ দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন করে।
একটি বিষয় এখানে নিশ্চিত হচ্ছি আমরা, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত, আর বাকি কোন বিষয়ের সাথে বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নেই। বাকি প্রতিটি বিষয় দলিল ও যুক্তি দ্বারাই প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু কথা হলো, ‘ধার্মীকরা বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত তাই তারা ভুল’ যে গ্রুপটা এই অপপ্রচার করে, তারা নিজেরা কতটুকু বিশ্বাস থেকে দূরে থাকতে পেরেছে ? তা হিসেব-নিকেষের বিষয় ।
বরং তারা নিজেরাও তো প্রতিটি বিষয়ের সাথে বিশ্বাসকে যুক্ত করে নিয়েছে, যা তাদের পৌছে দিয়েছে অন্ধবিশ্বাসে, হয়েছে কূপমণ্ডুক ও ব্যাকডেটেড।
যেমন- ধরুন
বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের সবুজ জার্সি। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জার্সি সবুজ বলে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের জার্সি সবুজ হতে পারবে না। পাকিস্তান দলের সাথে মিললে খারাপ, কারণ পাকিস্তান খারাপ। পাকিস্তান কেন খারাপ ? কারণ তারা ৭১ সালে আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে ? এখন যারা আছে, তারা নির্যাতন চালিয়েছে ? না তারা চালায়নি, কিন্তু তারা তো পাকিস্তানী, পাকিস্তান মানেই খারাপ। হুমায়ুন আজাদ স্যার বলেছে, “"আমি পাকিস্তানিদের কখনই বিশ্বাস করি না, যখন তারা গোলাপ ফুল হাতে নিয়েও আসে।”
এই দেখুন- তারা কিন্তু চলে গেলো বিশ্বাসে, যাকে আবার নাম দিয়েছে ‘চেতনা’। তারা কিন্তু আপনার ধর্মকে কটাক্ষ করে বিশ্বাস ভিত্তিক বলে। কিন্তু আজকে তারাই কিন্তু বিশ্বাস বা চেতনাকে আকড়ে ধরে আছে।
‘বাল্যবিয়ে করা যাবে না’- এটা একটা চেতনা বা বিশ্বাস। বাল্যবিয়ে খারাপ, এর বিপক্ষে বাস্তব কোন দলিল ও প্রমাণ তারা দেখাতে পারবে না। নেই কোন সাইন্টিফিক যুক্তি। বাল্যবিয়ে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু সমাজ সংরক্ষণে অক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের দরকার, এমন বহু দলিল আছে। গণহারে বাল্যবিয়ে বন্ধের কারণে সমাজে অনৈতিকতা, এইডস, সিজার অপরেশন বাড়ছে এমনও প্রমাণ করা যায়। কয়েকদিন আগে দেখি প্রচার করতেছে, জরায়ু ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের মূল কারণ কারণ নাকি বাল্যবিয়ে। অথচ জন্মনিরোধক পিল বা পদ্ধতির বহুল্ ব্যবহারের কারনে যে নারীদের এই রোগ বাড়তেছে, এটা কেউ বলে না, প্রচারও করে না।
‘কেমিক্যাল মানেই খারাপ’- এই কেমিক্যাল বিরোধী চেতনা বা বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়। এই ক্যামিক্যাল বিরোধী চেতনা বা বিশ্বাস ছড়িয়ে বহু ব্যবসা বাণিজ্য বা ফলমূল ধ্বংস করা হয়। এইজন্য পুরান ঢাকায় এক ব্যবসায়ী বলেছিলো, দেখুন ভাই, আপনি কেমিক্যাল মানেই দাহ্য বলে আমার ব্যবসা নষ্ট করতেছেন। কিন্তু আমি তো আগুন নির্বাপনে ব্যবহৃত কেমিক্যাল বিক্রি করি। আবার প্রাকৃতিকভাবে প্রতি ফলে ফরমালিন থাকে, সেই ফলমালিন কেন যন্ত্রে ধরা পড়লো, সেই অজুহাতে হাজার হাজার টন আম একবার ধ্বংস করা হয়েছিলো।
এরপর ধরুন, পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ আর মঙ্গল শোভাযাত্রা হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতি, এগুলোও একটা চেতনা বা বিশ্বাস। এতদিন এই চেতনা বিশ্বাসকে পূজি করে মানুষকে ধোকা দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু ফেসবুক অনলাইনে গোমর ফাঁস হয়েছে এই চেতনার সৃষ্টি মাত্র ৫০ বছর আর বাঙালী সন আবিষ্কারক বাদশাহ আকবর ফারসী ভাষী, জাতে মঙ্গলীয়। এখন এই তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়াতে তাদের ব্যবসা শিকেয় উঠছে।
রবীন্দ্রনাথ, নারী অধিকার, সাংস্কৃতিক চেতনা, আদিবাসী, ভাস্কার্য, সার্বজনিন উৎসব, সংখ্যালঘু, জঙ্গীবাদ, নুসরাত, জে সুই চার্লি, হলোকাস্ট এগুলো সবই এখন চেতনা বা বিশ্বাসের অন্তর্ভূক্ত।
আমরা যে চেতনা বা বিশ্বাসের কথা বলছি, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে তার অবস্থান ব্রেনের সাব-কনসাসে। প্রতিটি বিশ্বাস বা চেতনার কারণে সেই সাব-কনসাসে একটি বিশ্বাসদণ্ড তৈরী হয়, যেই দণ্ড দিয়ে সবকিছু পরিমাপ করে একজন ব্যক্তি। পক্ষে বললে ভালো লাগে, বিপক্ষে বললে রিয়্যাক্ট করে।
কথা হলো- আমরা কেন ধর্ম ছাড়া অন্য বিষয়গুলোকে বিশ্বাসের মধ্যে স্থান দিবো। পৃথিবীর সব কিছুই তো আপেক্ষিক। একটা সময় যা ভালো ছিলো, আগামীতে তা খারাপ হতে পারে। বিজ্ঞান আজকে যা বলছে, কালকে ফের তা পরিবর্তন করে নতুন সূত্র দিচ্ছে। তারমানে কোন কিছুই স্ট্যাবল নয়। তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা আজকে বিভিন্ন চেতনার জন্ম দিচ্ছি এবং সেটা দিয়ে সবাইকে পরিমাপ করছি ?
ধর্ম সাধারণত ছড়ায় দুটি বিষয় দিয়ে। একটি ধর্মগুরু, অন্যটি ধর্মগ্রন্থ। মুসলমানদের জন্য নবী ও কোরআন। ঠিক তেমনি, বর্তমানে যে গ্রুপটির কথা বলছি, তারা তাদের তত্ত্ব ছড়ায় দুটি বিষয়ের মাধ্যমে। একটি ‘সেলিব্রেটি’ এবং অন্যটি ‘চেতনা’। একজন্য তারা তাদের মিডিয়া, টিভি-পত্রিকা, সভা, সেমিনার, বই দিয়ে ব্যাপক প্রচার চালায়। প্রচারের মাধ্যমে তারা সেলিব্রেটি দাড় করায়, আবার চেতনাও দাড় করায়। এরপর সেই সেলিব্রেটির মুখ নিঃসৃত কথা ও চেতনা দিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কাজ চালায়। কখন নিজেদের স্বার্থে কাজ করে আবার কখনও বিপক্ষকে দমন করে।
আমার কথা হলো-
ধর্ম শুধু বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে, বাকি কোন ধারণা বা চেতনাই বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না, স্ট্যাবেল হতে পারে না। প্রত্যেকটি বিষয় আপেক্ষিক। তাই-
১) পাকিস্তান মানেই খারাপ
২) বাল্যবিয়ে করা ক্ষতিকর
৩) জাতীয় সংগীত না পড়লে দেশের শত্রু
৪) মুসলমান মানেই জঙ্গী,
৫) দাড়ি টুপি-বোরকা পড়লে জঙ্গী
৬) বাংলাদেশে থাকতে হলে রবীন্দ্রনাথকে মানতে হবে
৭) পহেলা বৈশাখ পালন না করলে বাংলাদেশী হতে পারবে না
৮) কেমিক্যাল মানেই খারাপ
৯) মোটাতাজা গরুতে বিষ থাকে, পোল্ট্রি মুরগীতে এন্টিবায়োটিক থাকে, আমের মধ্যে ফরমালিন থাকে
১০) ধর্ষণের জন্য পোষাক দায়ী না
এগুলো সব বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে, যার কোন বাস্তব ভিত্তি নাই।
হ্যা এগুলোও মেনে যায় যাবে, তবে যখন যে সেক্টরে এগুলোর প্রয়োগ ঘটানো হবে,
তার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তি তর্ক ও দলিলের উপর ভিত্তিকে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
কিন্তু চেতনা বা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এগুলো অন্ধভাবে মেনে কখনই যুক্তিযুক্ত নয়।