দেশীয় শিল্পাঞ্চল ধ্বংস করে বিদেশী শিল্পাঞ্চল তৈরী :

দেশীয় শিল্পাঞ্চল ধ্বংস করে বিদেশী শিল্পাঞ্চল তৈরী :
Image result for নদী
দেশীয় শিল্পাঞ্চল ধ্বংস করে বিদেশী শিল্পাঞ্চল তৈরী :
আসছে কর্পোরেটোক্রেসি বা সম্রাজ্যবাদী কর্পোরেটদের শাসন
এ পলিসিতে, কেমন হবে আমাদের আগামীর জীবন ব্যবস্থা ?
পুরান ঢাকার দেশীয় শিল্পাঞ্চল বিরোধী কার্যক্রম শুরুর পর দেখা গেলো, খুব দ্রুত তিনটি নতুন বিদেশী শিল্পাঞ্চলের ব্যাপারে ফাইনাল সিদ্ধান্ত আসলো-
১) মীরসরাইয়ে ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যাপারে অনুমোদন (https://bit.ly/2TojDGA)
২) আড়াইহাজারে জাপানে শিল্পাঞ্চলের অনুমোদন (https://bit.ly/2Trk9DR)
৩) ‘সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন’ (https://bit.ly/2XMCpG3)
অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঐ সব বিনিয়োগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যেন আটকে ছিলো কবে পুরান ঢাকার দেশীয় শিল্পাঞ্চল বিরোধী পদক্ষেপ শুরু করবে সরকার, যখনই শুরু হলো, তখনই বিদেশী কর্পোরেটদের সিদ্ধান্ত আসা শুরু করলো।
একটি বিষয় চিন্তা করে দেখলাম, বাংলাদেশে বিদেশী কর্পোরেটরা বিনিয়োগ করবে, শুধুমাত্র ‘সস্তা শ্রমিক’ এর আশায়। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা এতটাই খারাপ, শুধু মাত্র সস্তা শ্রমিকের আশা দিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকে বাংলাদেশ সরকার আকৃষ্ট করতে পারবে না। এ অবস্থায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের যদি সরকার দেশী মার্কেট ধরে দেয়ার নিশ্চয়তা দেয় (দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে), তবেই হয়ত তাদের আগমন ঘটবে।
উল্লেখ্য, সারাদেশে এরকম ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, এবং বাংলাদেশ সরকার বিদেশীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে সে সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আশায়। এ ফলাফলে হয়ত দেখা যাবে, শুধু পুরান ঢাকায় নয়, সারা দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারাখানাগুলোতে আগুন লাগবে এবং দেশীয় ব্যবসায়ীরা পথে বসতে থাকবে।
যাই হোক, এতদিন শুধু আলোচনা করেছি, ব্যবাসায়ীদের দৃষ্টিকোন থেকে,
এবার আসুন, আলোচনা করি, কর্পোরেটোক্রেসি বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের জীবন ব্যবস্থায় কেমন পরিবর্তন আসবে, সেটা নিয়ে।
প্রথমে জেনে নেই, কর্পোরেটোক্রেসি অর্থ কি ?
ডেমোক্রেসি- ডেমো শব্দের অর্থ জনগণ, ক্রেসি শব্দের অর্থ শাসন। তারমানে আক্ষরিক অর্থে ডেমোক্রেসি মানে জনগণের শাসন।
ঠিক একইভাবে কর্পেটোক্রেসি অর্থ-
কর্পোরেট বলতে এখানে বহুজাতিক ব্যবসায়ী বোঝায়, আর ক্রেসি অর্থ তাদের শাসন বোঝায়। তারমানে কর্পোটোক্রেসি অর্থ বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের শাসন।
বাংলাদেশ কিন্তু বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের শাসন প্রথম দেখেছিলো আজ থেকে ২০০ বছর আগে। বহুজাতিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চলের মানুষকে ব্যবহার করে নীল চাষ করেছিলো এবং একইসাথে এ অঞ্চলের মানুষকেও শাসন করেছিলো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক ছিলো ইহুদীবাদী রথ চাইল্ড ফ্যামিলি, আজকে তাদেরই বংশধররা বিভিন্ন বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানি নাম দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। তখন তারা ঢুকেছিলো মীর জাফরের সহায়তায়, এখনও ঢুকছে নতুন মীর জাফরের মধ্য দিয়ে।
কর্পোরেটোক্রেসি প্রক্রিয়া চললে খুব শিঘ্রই বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা ও সাধারণ মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে:
১) ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে ৫-৮ কোটি শ্রমিকের নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হবে। এই শ্রেণীটিকে সর্বোচ্চ সস্তায় পেতে চাইবে বিদেশী কর্পোরেটরা। এই সস্তায় শ্রমিক পাওয়ার জন্য দুইটি কাজ করা হবে, এক-দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করে বেকারত্ব বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়া হবে, দুই- জীবন ব্যয় (খাদ্য, বাড়িভাড়া, যাতায়াতভাড়া) বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়া হবে।
২) একজন শ্রমিকের বেতন হবে ৫-৬ হাজার টাকা। কিন্তু বাসাভাড়া, গাড়িভাড়া আর ভাত-ডালের খরচ এত আকাশচুম্বি হবে যে, একজনের ইনকামে সংসার চলবে না। তখন প্রতি পরিবারের বাবার পাশাপাশি, মা, ভাই-বোন সবাই বিদেশী কর্পোরেটদের শ্রমিক বা দাস হয়ে যাবে। কমমূল্যে নারী শ্রমিক পাওয়ার জন্য নারীবাদ, নারী ক্ষমতায়নের বা বাল্যবিয়ে বন্ধের ব্যাপক শ্লোগান লক্ষ্য করা যাবে।
৩) দেশে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। কিছু কিছু পর্যটন এলাকা আন্তর্জাতিক মানের হবে। এছাড়া দেশে হবে প্রচুর ভাইভ স্টার, সেভেন স্টার হোটেল, যেখানে বিদেশীরা এসে অবস্থান করতে পারবে। ঐ সময় বাংলাদেশে এসকর্ট সার্ভিস বা পতিতাবৃত্তি খুব এভেইলএবল হবে। যেহেতু বাংলাদেশের উৎপাদন খাত পুরোপুরি বিদেশীদের হাতে থাকবে, তাই বাড়তি ইনকামের জন্য ঘরের পুরুষদের কিছুই করার থাকবে না। তখন ঘরে বাড়তি কিছু খরচ দরকার হলেই ঘরের নারীরা এসকোর্টে গিয়ে পরপুরুষের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আসবে এবং ঘরের বাড়তি খরচের প্রয়োজন মেটাবে।
৪) যে সমাজটা বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের স্বপ্ন দেখে, তাদের আশায় গুড়ে বালি হবে। কারণ বাংলাদেশে ধর্মীয় বিষয়গুলো ধারণ করে রাখে মধ্যবিত্ত সমাজ। যেহেতু মধ্যবিত্ত সমাজের পতন হবে, সেহেতু ঐ সমাজেরও পতন হবে। তখন যে শ্রেণীর উদ্ভব হবে সেটা হবে নিম্নবিত্ত বা শ্রমিক শ্রেণী। আপনি এখনও দেখতে পারেন, সমাজে যে শ্রমিক শ্রেণী আছে, বিশেষ করে রিকশাওয়ালা বা কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে কিন্তু ধর্মের খুব একটা চর্চা দেখা যায় না্, ঐ শ্রেণীটির সারাদিন চিন্তা থাকে, কি করে সারাদিন কামাই করবো, আর দিন শেষে কামাইয়ের টাকা দিয়ে পেট ভরবো।
এছাড়া পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের সাথে যদি আপনি আলাপ করেন, দেখবেন তারা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্রাম গঞ্জে কোন মসজিদ বা মাদ্রাসা চালায়। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের পতন হলে ঐ মসজিদ-মাদ্রাসাগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে থেমে যাবে। শুধু পুরান ঢাকা নয় দেশের স্বনির্ভর বা ব্যবসায়ী শ্রেণীর পতন হলে অনেক মসজিদ-মাদ্রাসা অভিভাববহীন হয়ে পড়বে। তখন মসজিদ মাদ্রাসা বলতে থাকবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চলা মসজিদ মাদ্রাসা। সরকার যেটা বলতে বা করতে বলবে, তারা সেটাই করবে।
৫) শহর বিশেষ করে রাজধানী হবে অত্যাধুনিক, খুব গুছানো, পরিপাটি। আধুনিক সব ব্যবস্থা থাকবে সেখানে। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর বসবাস থাকবে সেখানে। তবে তার আড়ালেই কোন বস্তি এলাকা থাকবে, যারা কিছুদিন আগেও হয়ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক ছিলো। এ শ্রেনীটি ঐ ধনী শ্রেণীর গৃহকর্মী হিসেবে সার্ভিস দিবে।
৬) মানুষ শ্রম-ওভার টাইমের দিকে মনোযোগ বেশি দিবে, ঘরসংসারে কম সময় দিবে। ফলে বিয়ে-শাদী কম হবে, ডিভোর্স বেশি হবে, জন্মহারও কমে যাবে।
৭) উচ্চতর লেখাপড়া খুব ব্যয়বহুল হবে, সাধারণ পরিবারের পক্ষে তা আর সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হবে। ঋণ নিয়ে লেখাপড়া করবে কেউ কেউ। সেই ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করবে, নারীরা দেহ বিক্রি করবে।
৮) দেশে অগাধ সম্পদ থাকবে, বিদেশী কোম্পানিগুলো দেশী মীর জাফরদের সহায়তায় তা উত্তোলন করে নিয়ে যাবে। কিন্তু সামান্য খাদ্য বা চিকিৎসার অভাবে মানুষ জীবন হারাবে।
৯) কর্পোরেটোক্রেসির একটা বড় ফলাফল হলো পরিবেশ দূষণ বা বিপর্যয়। এই বড় বড় শিল্পকারখানা বানাতে বা তাদের শক্তি (বিদ্যুৎ) সরবরাহ করতে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ হবে, আবার তারা যে বর্জ নিঃসরণ করবে সেটারও বিষও জনগণকে নিতে হবে। আপনি দেখবেন , সরকার পরিবেশ বা নিরাপত্তার কথা বলে পুরান ঢাকার ব্যবসা বাণিজ্য উচ্ছেদ করছে, কিন্তু রামপাল বা রূপপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ দূষণের কথা কিন্তু বেমালুম ভুলে যাচ্ছে।
১০) যেহেতু জোর করে একটি শ্রেণীকে দরিদ্র বানানো হবে, উচ্ছেদ করা হবে, সেহেতু তাদের মধ্যে থেকে একটি শ্রেণী হবে যারা হিংস্র হয়ে উঠবে এবং বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে যাবে। এরা সমাজে খুন খারাপি-ছিনতাই মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে। ধনীরা নিজেদের নিরাপত্তায় সিকিউরিটি সার্ভিস নিয়োগ দিবে, কিন্তু দরিদ্রদের জান-মালের কোন দাম থাকবে না।
কর্পোরেটোক্রেসি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শাসন বাস্তবায়ন হলে সমাজ কেমন হবে, সেটা নিয়ে আমি যে আলোচনা করলাম, সেটা কোন কাল্পানিক আলোচনা নয়। আপনি দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার দিকে তাকান তবে অনেক রাষ্ট্রেই্ এ ধরনের সমাজ দেখতে পারবেন। বাংলাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার নামে বিদেশীদের আগমন আমাদের সেই আভাস-ই দেয়। অনেকে হয়ত বলতে পারেন, তবে কি বিদেশী বিনিয়োগ আসা করবো না ? অবশ্যই করবেন, তবে সেটা নিজের অবস্থান ধরে রেখে, যেন বিদেশীরা আমার উপর তার ক্ষমতা বিস্তার না করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে পুরান ঢাকা নিয়ে যে রাষ্ট্রীয় পলিসি দেখা যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট হয়েছে, ক্ষমতা আর টাকার লোভে শাসকরা বিদেশী কর্পোরেটেদের সাথে দেশ বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও সাধারণ জনতা তা এখনও বুঝতে সক্ষম হয়নি।