ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় প্রথম শহীদ আবরার ফাহাদ তার শেষ স্ট্যাটাসে একটি ভারতীয় নদীর কথা উল্লেখ করেছিলো যার নাম কাবেরী নদী। এন.সি- ১২১

ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় প্রথম শহীদ আবরার ফাহাদ তার শেষ স্ট্যাটাসে একটি ভারতীয় নদীর কথা উল্লেখ করেছিলো যার নাম কাবেরী নদী।
Related image
ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় প্রথম শহীদ আবরার ফাহাদ তার শেষ স্ট্যাটাসে একটি ভারতীয় নদীর কথা উল্লেখ করেছিলো যার নাম কাবেরী নদী। কাবেরী নদীটি ভারতের কর্নাটক প্রদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে তামিলনাডু প্রদেশে প্রবেশ করে বঙ্গপোসাগরে মিশেছে।এই নদীর পানি নিয়ে দুই প্রদেশের মধ্যে ১০০ বছর ধরে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান আছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে দুই প্রদেশের জনগণের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। তামিল নাডুর কৃষকরা নদীতে নেমে প্রতিবাদ করতে থাকে, নদীর উপকূলের গলা পর্যন্ত বালিতে কবর দিয়ে মানুষের মাথার খুলি আর হাড় নিয়ে প্রতিবাদ করে। অপরদিকে কর্নাটকের জনগণ রাস্তায় নেমে দাঙ্গা শুরু করে।
শহীদ আবরার ফাহাদ এই সূত্র ধরে বলেছিলো- এক দেশের এক রাজ্য যখন অন্য রাজ্যকে পানি ছাড় দেয় না, তখন আমরা কেন ‘বিনিয়ম ছাড়া’ পানি দিবো ?
লক্ষ্য করুন- তিনি বলেননি পানি দেয়া যাবে না,
বরং তিনি -‘বিনিয়ম ছাড়া’ শব্দ যুগল ব্যবহার করেছেন।
ভারত সফর শেষে শেখ হাসিনা এই চূক্তি নিয়ে অবশ্য তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন,
যদিও তিনি তার ব্যাখ্যায় জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। কারণ- তিনি তার কাজের ব্যাখ্যায় বার বার বিএনপি আমলের সাথে তুলনা করে নিজের কাজকে ভালো প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে হয়ত প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে চুপ করাতে পারবেন, কিন্তু জনগণকে চুপ করাতে পারবেন না। তাছাড়া- অন্য কোন রাজনৈতিক দলের তার এ বিষয়ে তুলনাও করাও ঠিক নয়। কারণ বর্তমান আর্ওয়ামী সরকারের মত এত সময় ধরে ক্ষমতায় আর অন্য কোন রাজনৈতিক দল ছিলো না, কিংবা কেউ তার ক্ষমতায় বলেওনি- দুই দেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে কিংবা স্বামী-স্ত্রীর পর্যায়ে চলে গেছে।
শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেছেন- আমরা খুব শিঘ্রই দুই দেশের মধ্যে নদীগুলোর খনন শুরু করবো। সম্ভবত তিনি protocol on inland water transit and trade (piwtt) চূক্তির কথা বলছেন, যে চূক্তির আওতায় বাংলাদেশের নদীপথগুলো ব্যবহার করতে পারবে ভারত (এই চূক্তি নিয়েও বেশ অবজেকশন আছে)।
যেটা বলছিলাম- শহীদ আবরারের স্ট্যাটাসে ‘বিনিময় ছাড়া পানি’র বিষয়টি নিয়ে।
শহীদ আবরার কিন্তু যথেষ্ট কূটনৈতিক ও ইন্টিলিজেন্ট বক্তব্য দিয়েছেন, এই `বিনিময়' শব্দ দিয়ে। চূক্তি মানেই দ্বিপাক্ষীক বিনিয়ম, এক পাক্ষীক নয়। যদিও শেখ হাসিনা চূক্তি দ্বী-পাক্ষিক কি না, সেটা ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, বরং ‘পানি খাওয়ার মানবিক কারণ’ এই শব্দগুলো নিয়ে এসেছেন। আসলে মানবিক কারণ বিবেচনা করে কখন চূক্তি হয় না। মানুষ কোন ভিক্ষুক্ষের সাথে কখন চূক্তি করে না, তোমাকে প্রতিদিন বাকি ভিক্ষা দিতে বাধ্য থাকবো, বরং ইচ্ছা হলে দেয়, না ইচ্ছা হলে না দেয়। অর্থাৎ মানবিক কারণে চূক্তি হয় না, চূক্তি হয় দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ বিনিময়ের মাধ্যমে।
তবে ‘পানি নেয়া ভারতের অধিকার’ শেখ হাসিনা এ বাক্যটিও সম্ভবত একবার বলেছেন। অধিকার প্রশ্ন যখন আসবে, তখন বাংলাদেশেরও ৫৪ নদীর পানি পাওয়া অধিকার সেই প্রশ্নও আসবে। তখনই আসবে বিনিময় প্রশ্ন। কিন্তু শেখ হাসিনা বিনিময়ে বিশ্বাসী নয়, তিনি দানে বিশ্বাসী, যা তিনি আগেও বলেছেন, সেটাকেই সুন্দর করে কামিনী রায়ের কবিতা দিয়ে বলেছেন শহীদ আবরার।
যাই হোক, শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে একটি কথা বারবার বলেছেন- আমি বুঝতেছি না, কেন এইসব চূক্তির বিরোধীতা হচ্ছে।
কথা হলো- এই বিরোধীতা কি অপপ্রচার থেকে হচ্ছে না ভয় থেকে হচ্ছে ?
আমার তো মনে হয়- এটা হচ্ছে ভয় থেকে। জনগণের অধিকার হলো বৈদেশিক চূক্তির ব্যাপারে জানা,
কিন্তু সেই জানার বিষয়টি নিয়ে যখন লুকোচুরি হচ্ছে, সেখান থেকেই ভয় তৈরী হচ্ছে। আর ভয় থেকে হচ্ছে বিরোধীতা।
উল্লেখ্য- সংবিধানের ১৪৫ক অনুচ্ছেদের বৈদেশিক চূক্তির ব্যাপারে আছে,
বৈদেশিক চূক্তির বিষয়টি প্রথমে রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করতে হবে,
এরপর রাষ্ট্রপতি সেটা সংসদে উত্থাপন করবেন ।
যেহেতু এইসব চূক্তি জাতীয় নিরাপত্তার সংশ্লিষ্ট হয়,তাই এখানে লুকোচুরির কোন কারণ থাকতে পারে না।
কিন্তু সমস্যা হলো- এই অনুচ্ছেদের ফাক ফোকরকে কাজে লাগিয়ে সরকার বলছে- আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করি, সে সংসদে উত্থাপন না করলে আমাদের কিছু করার নাই।
কথা হলো- সংসদে আলোচনা না করার দোষ রাষ্ট্রপতি না সংসদের তা জনগণ বুঝবে না।
কারণ- রাষ্ট্রপতি যে সরকারের অংশ, বানানো পুতুল, সেটা সবার জানা।
এই রাষ্ট্রপতির কাজ যদি বৈদেশিক চূক্তি সংসদে উত্থাপন করা হয়,
তবে সেটা তার ঠিকমত করা উচিত, কারণ একমাত্র জোকারি ছাড়া আমি রাষ্ট্রপতির অন্য কোন কাজ দেখি না।
মূল কথা হলো- দুইটা দেশ যেহেতু পাশাপাশি আছে, তাই দুই দেশের মধ্যে চূক্তি হওয়া খুব স্বাভাবিক।
তবে মানুষ যখন কোন কিছু নিয়ে লুকোচুরি দেখে, তখন তা নিয়ে ভয় পায়।
আর সেই ভয় থেকেই বিরোধীতা হয়।
শেখ হাসিনা যেহেতু দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু করবেন না, বারবার বলছেন,
তাহলে গত ১০ বছরে ভারতের সাথে হওয়া প্রায় শতাধিক চূক্তি জনসম্মুক্ষে প্রকাশ করতে সমস্যা কোথায়? শেখ হাসিনারই বা এখানে ভয় কিসের?
কেন তিনি সফরে যাওয়ার, আগের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিংকরে বলেন, এবার ভারত সফরে ১০-১২টি চূক্তি হতে পারে, কেন তিনি বিস্তারিত বলেন না ? কেন সংসদে চূক্তির বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা হয় না। কেন বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে চূক্তি ভারতীয় মিডিয়ার মূখে আগে দেখতে হয় ?
যতদিন ভারতের সাথে চূক্তি নিয়ে লুকোচুরি করা হবে, ততদিন এর বিরোধীতা বন্ধ হবে না, চলতেই থাকবে।
ছবি: কাবেরী নদীর পানি নিয়ে ভারতের তামিল নাডু ও কর্নাটকের জনগণের মধ্যে দাঙ্গা-বিক্ষোভের ছবি।