যদি কৃষি জমি নষ্ট না করে কলকারখানা করা হয় তবে সমস্যা কি ? এন.সি-৬৪

Image result for তালা
কেউ কেউ কমেন্টে লিখেছে,
আপনার লেখার মর্মার্থ বুঝি না, যদি কৃষি জমি নষ্ট না করে কলকারখানা করা হয় তবে সমস্যা কি ?
যারা এই প্রশ্ন করেছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ।
কারণ আপনারা প্রশ্ন করেছেন বলেই আলোচনা হচ্ছে এবং সেই আলোচনা থেকে বেড়িয়ে আসছে নতুন কিছু।
আসলে এই কথাগুলো সরাসরি বোঝা একটু কঠিন, তাই উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে। ধরুণ-
কোন এক পরিবারের প্রধান ‘বাবা’। বাবার কোন ইনকাম নাই। তবে তার আছে ১০ সন্তান। সন্তানরা আলাদা আলাদা ইনকাম করে। সন্তানরা মাস শেষে বাবার হাতে তাদের উপার্জিত অর্থ তুলে দেয়, সেই অর্থ আবার পুরো সংসার চালানোর কাজে ব্যয় করে বাবা। পাশাপাশি যে ১০ সন্তান ইনকাম করে, তাদের কেউ কৃষি কাজ করে, কেউ দোকানপাট-ব্যবসা করে। তাদের কাজের সুবিধার্থে তাদেরকেও মাঝে মাঝে টাকা-পয়সা দিতে হয়। এতে তাদের কাজের গতি ঠিক থাকে বা বৃদ্ধি পায়। তবে সব কিছুই হয় টেনেটুনে। মাস শেষে কোন অতিরিক্ত টাকা থাকে না।
এখন হঠাৎ করে ঐ বাবা’কে কোন এক প্রতিবেশী বুদ্ধি দিলো,
মাস শেষে তো আপনার হাতে অনেকগুলো টাকা আসে, আপনি এক কাজ করেন না কেন, আপনি শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করেন, কোন কষ্ট করা লাগবে না, রাতারাতি বড়লোক হতে পারবেন।
প্রতিবেশীর বুদ্ধিতে তো বাবা’র ঘুম হারাম। সে চিন্তা করলো ঠিকই তো, আমি যদি শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা করতে পারি, তবে রাতারাতি বড়লোক হতে পারবো। যেই বুদ্ধি সেই কাজ।
এবার মাস শেষে যখন বাবা’র হাতে সন্তানরা টাকা তুলে দিলো- তখন বাবা সেই টাকার একটা বড় অংশ শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করে দিলো। যেহেতু টানাটানির সংসার। তাই একদিকে টাকা গেলে অন্য দিকে টাকার টান পরে। ফলে ঐ মাসে সংসার চলার খরচ কমতি পরে। এতে চিকন চালের পরবর্তীতে মোটা চাল খেতে হয়, বড় মাছের যায়গায় ছোট মাছ খেতে হয়, দেশী মুরগীর যায়গায় বয়লার মুরগী খেতে হয়। এছাড়া বাচ্চাদের পড়ালেখা, অসুস্থ রোগীর ওষধ, আর জামা কাপড় ক্রয়েও টানাটানি পড়ে। পাশাপাশি এক সন্তানের ব্যবসায় কিছু মাল কেনার জন্য নগদ টাকার দরকার ছিলো সেটাও বাদ দিতে হয়ে। ফলে তাদের ব্যবসা দুর্বল হয়ে যায়। আরেক সন্তানের কৃষি জমিতে ভালো বীজ কেনার জন্য কিছু টাকার দরকার ছিলো। সেটা না পেয়ে খারাপ বীজ কিনতে হয়।
এদিকে, শেয়ার মার্কেট নতুন নেমে হঠাৎ করে লাভ আসে না। লস খেতে হয়। তখন ঐ প্রতিবেশী বুদ্ধি দেয়, এক মাসে তো লাভ হবে না, আপনি টানা ১২ মাসের টার্গেট নেন, দেখবেন এরপর লাভ আসা শুরু করবে। আর ইনভেস্টের টাকার পরিমানও বাড়িয়ে দেন।
ঐ বাবা’র তো শেয়ার মার্কেটের প্রতি নেশা হয়ে গেছে। সে প্রতি মাসে তার ইনভেস্ট চালিয়ে যেতে থাকে। এমনকি সন্তানদের বলে দেয়- আগে যা টাকা দিতে, এখন আরো বেশি করে টাকা দিতে হবে, নয়ত তোমার ব্যবসা বা কৃষি কাজ বন্ধ । ফলে ভয়ে পড়ে সন্তানরা বাবাকে আরো বেশি টাকা দিতে থাকে, কিন্তু তারা বাবার থেকে আগে যে সাহায্য পেতো, এখন সেটাও পাচ্ছে না। আবার টাকাও দিতে হচ্ছে বেশি। ফলে তাদের ইনকাম পড়তির দিকে যেতে থাকে, এক সময় কয়েকজনের ব্যবসা বা কৃষি কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে সংসারে টানা পোড়েন শুরু হয়ে যায়, সংসার চালানো দায় হয়ে যায়। ১ বেলা খাবার কমিয়ে দিতে হয়। পড়লেখা, চিকিৎসায় সংকট পড়ে। কিন্তু এতেও ঐ বাবার মন ভরে না। সে ঘরের অংশ বিশেষ বাইরের লোককে ভাড়া দিয়ে সেই টাকা শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট চালিয়ে যেতে থাকে। কারণ একবার লাগলেই অনেক টাকা আসবে, কিন্তু কবে আসবে, কত আসবে সেটার নিশ্চয়তা এখন ঐ বাবা’র পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ সংসারটির সাথে যদি আপনি বর্তমান দেশের অবস্থা তুলনা করেন, তবে কিছুটা হয়ত বুঝতে পারবেন। এক্ষেত্রে ঐ বাবার যায়গায় কল্পনা করবেন সরকারকে, আর পরিবারের সদস্যদের সাথে তুলনা করবেন- সাধারণ জনগণ, ব্যবসায়ী, কৃষকসহ সকল উৎপাদককে।
এখানে কিন্তু ঐ বাবা তার সন্তানদের কর্মক্ষেত্রে কোন সমস্যা করে নাই, বন্ধও করে দেয় নাই। কিন্তু এমন পলিসি নিয়েছে, যাতে তার কর্ম শেষ হয়ে যায়। তবে মূল পয়েন্ট হলো- যদি ঐ পরিবারটি টানাটানির সংসার না হয়ে, যদি এমন সংসার হতো, যেখানে অতিরিক্ত টাকা জমা থাকে, তবে সেই জমা থেকে খরচ করতে সমস্যা ছিলো না। কিন্তু সংসারটি নিজেই এখন স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়, এ অবস্থায় বাইরের জন্য ইনভেস্ট করা মাসে পুরো পরিবারের উপর আঘাত আসা।
বর্তমান সরকার প্রধান কিন্তু নিজ মুখেই বলছেন- কৃষি জমি ধ্বংস করে শিল্পকারখানা নয়।
অথচ তিনি নিজেই বলছেন- আমরা কৃষি থেকে শিল্পের দিকে প্রত্যাবর্তন করছি।
অর্থাৎ ঐ পরিবারের বাবার মত তার খেয়াল ঘুরে গেছে। তার বাসায় যারা সোর্স অব ইনকাম আছে, তাদের থেকে খেয়ালটা বিদেশীদের দিকে ঘুরে গেছে। কিন্তু এখানে আগে উচিত ছিলো- তার সন্তানদের উপার্জনের স্থলগুলোকে আরো শক্তিশালী ও স্থায়ী করা। কিন্তু সেটা না করে সে বাইরের থেকে কবে টাকা আসবে সেই আশায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র, অতিরিক্ত গ্যাস মজুদ, ফ্লাইওভার, ট্যানেল, বহুমুখী রাস্তা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, পর্যটনে ব্যাপক খরচ করে যাচ্ছে। প্রয়োজনে সন্তানদের থেকে বেশি করে টান দিয়ে, ট্যাক্স বাড়িয়ে, ফি-মাসুল-জরিমানা-রেজিস্ট্রেশন-গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেল খরচ বাড়িয়ে সে বেশি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।
অনেকে হয়ত বলতে পারেন- ভাই দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে সেখানে তো দেশী ব্যবসায়ীরাও কলকারখানা করতে পারবে।
হা করবে, কিন্তু কতজন সেই সময় পর্যন্ত টিকে থাকবে এবং কতজন করতে পারবে সেটারও হিসেব করার দরকার আছে। বিশ্বাস না হয়, আপনি দেশের আপামর ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলুন। সেটা ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি বা বৃহৎ। সবাইকে জিজ্ঞেস করুন, আপনার ব্যবসার অবস্থা কি ? তাদের কথার উত্তর শুনলেই বুঝবেন- সরকারের বর্তমান দেশীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আচরণ বা পলিসি কেমন। ঐ পরিবারে যেমন- বাবা তার সন্তানদের মধ্যে যে ব্যবসায়ী আছে তাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, উপরন্তু তাকে আরো চুষে টাকা নিয়েছে, ঠিক তেমনি বর্তমান সরকার দেশী ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং প্রতিদিন কত নিত্য নতুন উপায়ে চোষণ করা যায় সেই ধান্ধা করতেছে। এতে ২-৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আর কতজন ব্যবসায়ী টিকে থাকতে পারে, তার হিসেব কষার দরকার আছে ।
তবে পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার এবং ঐ বাবার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে।
বাবা তার পরিবারের সদস্যদের খাবার খরচ কম দিয়ে সেই টাকা তুলে নিচ্ছে,
আর সরকার নিচ্ছে অন্য কায়দায়, যেমন-
১) নিজস্ব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দিয়ে কৃত্তিম সংকট তৈরী করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছে। উদাহরণ- চাল-পেয়াজের দাম।
২) যারা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে তাদের কাচামালের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে এনে রেজিস্ট্রেশন ফি, অমুক – তমুক ফি নাম করে নানান কায়দায় টাকা নিচ্ছে। ফলে তারাও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, খরচ বাড়ছে জনগণের।
৩) সরকার নিজেই টাকা ছাপিয়ে সেই টাকা খরচ করছে। এতে মূল্যস্ফীতি দেখা দিচ্ছে, দ্রব্যমূল্যে দাম ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
যেহেতু কর্পোরেটোক্রেসির পুরো সিস্টেমটা শুরু হয় উন্নয়নের নাম দিয়ে এবং বাস্তবায়ন হয় খরচ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। তাই এই সিস্টেম বন্ধ হওয়ার জন্য যেটা জরুরী-
বিদেশীদের আনার জন্য কথিত উন্নয়নের প্রতিটার বিরোধীতা করা এবং জনগণের খরচ কমাতে তীব্র দাবী তোলা। তাহলেই এই অর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।